ফ্লয়েড হত্যা: বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ-প্রতিবাদ, সমালোচনা

যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে পুলিশের নিপীড়নে এক কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে কয়েকদিন ধরেই চলছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2020, 08:52 AM
Updated : 2 June 2020, 09:54 AM

এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়া হাজার হাজার মানুষ কেবল মার্কিন বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থনই জানাচ্ছেন না, নিজেদের দেশের বর্ণবাদ ও নানা ধরনের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধেও ক্ষোভ ব্যক্ত করছেন বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

চীন ও ইরানের মতো যুক্তরাষ্ট্রে অনেক সমালোচক দেশ দাবি করেছে, পুলিশি নিপীড়নে মৃত্যু এবং পরবর্তী ঘটনাক্রম `ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া’ ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ‘ভণ্ডামি ও দাম্ভিকতাকেই’ তুলে ধরেছে।

বার্লিন, লন্ডন, প্যারিস, ভ্যাঙ্কুবার, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রাস্তা থেকে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাজধানীগুলোতেও সমালোচনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। লড়াই-সংঘাতে বিপর্যস্ত সিরিয়ার একাংশে শিল্পীরা এঁকেছেন বর্ণবাদবিরোধী ম্যুরাল। চিলি আর লেবাননের আন্দোলনকারীরা মার্কিন বিক্ষোভকারীদের দিচ্ছেন পুলিশি নির্যাতনের হাত থেকে সুরক্ষার নানান পরামর্শ।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই বিশ্বজুড়ে এ ক্ষোভের জন্ম হয়েছে গত সপ্তাহে মিনিয়াপোলিসে শ্বেতাঙ্গ এক পুলিশ কর্মকর্তার হাতে ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে।

শ্বেতাঙ্গ ওই পুলিশ কর্মকর্তা হাতকড়া পরিহিত ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু তুলে দিয়ে তাকে মাটিতে চেপে ধরেছিলেন। সেসময় কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডের কণ্ঠে ছিল আকুতি, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’।

পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফ্লয়েডকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার পর প্রথমে মিনিয়াপোলিস ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের শতাধিক শহর উত্তাল হয়ে ওঠে। ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি অসংখ্য এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

যে পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডকে মাটিতে চেপে ধরেছিলেন তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। 

শুক্রবার রাতে হোয়াইট হাউসের দিকে কয়েকশ বিক্ষোভকারীরা তেড়ে আসার সময় ট্রাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিক্রেট সার্ভিসের কর্মীরা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারের ভেতর নিয়ে গিয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এরপর থেকে ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে বলা ‘বাঙ্কারবয়’ শব্দও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেয়া বিধিনিষেধ অবজ্ঞা করেই লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চারপাশজুড়ে বিক্ষোভ দেখায় কয়েক হাজার মানুষ। তারা ফ্লয়েডের নাম, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, ও ‘বিচার নেই, শান্তি নেই’ স্লোগান দেয়।

বিক্ষোভকারীরা পরে সেখান থেকে গ্রেনফেল টাওয়ারে যায়; ২০১৭ সালে এই টাওয়ারে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অসংখ্য আরব, মুসলিম ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বাসিন্দা নিহত হয়েছিলেন।

তিন বছর আগে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মারকে প্রতিবাদকারীদের একজন লেখেন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’।

টরন্টোতে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ অবসান চাওয়ার পাশাপাশি গত সপ্তাহে কানাডায় মারা যাওয়া ২৯ বছর বয়সী রেজিস করচিনস্কি-পাকেতের ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন।

পুলিশ বলছে, রেজিস নিজের অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনি থেকে নিচে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যদিকে তার পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, ২৯ বছর বয়সী এ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে ঘটনাস্থলে সেসময় হাজির থাকা পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা রয়েছে।

প্যারিসে ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে কর্মসূচি আহ্বান করাদের মধ্যে অ্যাডামা ত্রায়োরের পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন। ২০১৬ সালে পুলিশ হেফাজতে ২৪ বছর বয়সী অ্যাডামার মৃত্যু হয়েছিল। তার বোন আশা এখন ‘দ্য ট্রুথ ফর অ্যাডামা’ নামে একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

ফ্লয়েডের মৃত্যু চার বছর আগে তার ভাইয়ের মৃত্যুর কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য আশার।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১৪০টি শহরে ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। এর মধ্যে অনেক এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে, যা নিয়েও বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভকারীরা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে আফ্রিকান-আমেরিকান ও অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বেশি আক্রান্ত-মৃত্যুর বিষয়টি যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি বিশ্বজুড়ে ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে হওয়া কর্মসূচিগুলোতে মহামারীতে বাড়তে থাকা অসাম্যের বিষয়টিও উঠে এসেছে।

কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসেও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত-মৃত্যুর সংখ্যা শ্বেতাঙ্গদের ‍তুলনায় দ্বিগুণ বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

শনিবার বার্লিনে কয়েকহাজার বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বাইরে ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সপ্তাহান্তে হওয়া জার্মান ফুটবল লীগের খেলায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের তিন খেলোয়াডও ফ্লয়েডের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

মন্ট্রিয়লে রোববারের বিক্ষোভেকে পুলিশ ‘অবৈধ’ অ্যাখ্যা দেয়ার পর সেটি সহিংসতায় রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে প্রজেক্টাইল ছুড়লে পুলিশও কাঁদানে গ্যাস ও পেপার স্প্রে ব্যবহার করে।

সিরিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবে দুই চিত্রশিল্পী ভাঙাচোরা একটি ভবনে একটি ম্যুরাল এঁকেছেন; যাতে লেখা রয়েছে, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’, ও ‘বর্ণবাদকে না’।

মহামারী মোকাবেলায় বেইজিংয়ের ব্যর্থতা নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনা করে এসেছেন ট্রাম্প। এর প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত চীনা কর্মকর্তারা এবার যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলমান বিক্ষোভকে নিজেদের ঢাল হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন।

চীনের রাষ্ট্র-পরিচালিত গণমাধ্যমগুলো ফ্লয়েডের মৃত্যু ও এর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে হওয়া আন্দোলন নিয়ে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে হওয়া বিক্ষোভকে দেশটির পতনের অন্যতম ইঙ্গিত হিসেবেও চিত্রায়িত করছে তারা।

হংকংয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের লক্ষ্যে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির পদক্ষেপ নিয়ে শনিবার টুইটারে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এক কর্মকর্তা তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

চীনা সরকারের এক মুখপাত্র ওই সমালোচনার জবাব ফিরিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনের জনপ্রিয় স্লোগান দিয়ে।

“আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না,” টুইটারে মার্কিন কর্মকর্তার সমালোচনার জবাবে এমনটাই বলেছেন চীন সরকারের মুখপাত্র হুয়া চুনইং।

২০১৮ সালে ইরানের দুর্নীতি ও অন্যায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বিবৃতিকে সম্পাদন করে ইরানের জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রকে বসিয়ে একটি ছবি দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাভাদ জারিফ।

“কেউ কেউ মনে করেন না যে কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনেরও মূল্য আছে,” টুইটারে লিখেছেন তিনি।

আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের প্রধান মুসা ফকি মাহমাত শুক্রবার এক বিবৃতিতে ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ‘কৃষ্ণাঙ্গদের উপর ধারাবাহিকভাবে চলমান বৈষম্য’ নিয়েও সমালোচনা করেছেন তিনি।

সোমবার এক বিবৃতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বিক্ষোভের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় সমাধান করতে পারবে বলে তারা আশা করছে।

সাধারণত কম গণতন্ত্রসম্পন্ন দেশ, যেখানে মানবাধিকারকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় না, সেসব দেশে সহিংস আন্দোলনের বেলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।