অবরুদ্ধ লোকালয়ে আকাশজুড়ে ঘুড়ি

বোরহান বিশ্বাস
Published : 25 April 2020, 08:31 AM
Updated : 25 April 2020, 08:31 AM

বছরের এই সময়টাতে ঘুড়ি ওড়ানোয় মেতে ওঠে শিশু আর বড়রা।  কিন্তু এই বছরের এই সময়টা ভিন্নভারে ধরা দিয়েছে। কিন্তু মহামারী ভুলে থাকতে ঘুড়ি ‍ উড়িয়েই যেন সুন্দর একটা দিনের প্রার্থনা উড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের আকাশজুড়ে।

ছোট-বড় অনেকেই পারিবারিকভাবে এখন বিকেলটা বাড়ি ছাদেই কাটান। বাবা-কাকার সঙ্গে বাড়ির ছোটরাও ঘুড়ি ওড়াতে যোগ দিচ্ছেন। জীবিকার অনেক খাতে এখন লাগাম পড়লেও  রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নাটাই, সুতা আর ঘুড়ি বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।

নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। সে কথা মনে রেখেই বিশেষ প্রয়োজনে মাস্ক, গ্লভস পরে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে বাসা থেকে বের হলাম। সামান্য দূরে যেতেই চোখে পড়লো কেউ ঘুড়ি, কেউ নাটাই হাতে ছুটছেন। এ যেন ঘুড়ি উৎসবের প্রস্তুতি চলছে।


২৫ বছর বয়সী একজন পরিচিত তরুণকে দেখলাম ১০টি ঘুড়ি হাতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন। ডাক দিতেই এগিয়ে এলেন। তবে  দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বললাম আমরা।

তরুণ বললেন, প্রতিটি ঘুড়ির মূল্য ২০ টাকা।

আমি কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ক'দিন যাবে?

তিনি হেসে বললেন, এটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। উপরে (আকাশে) কাটাকাটি করে যে টিকে থাকতে পারে। একদিনেই শেষ হয়ে যেতে পারে সব ঘুড়ি। আবার ১০ দিনও চলতে পারে।

অন্য সবকিছু কি ঠিকঠাক আছে? তরুণের আঙুলে লাগানো ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ দেখিয়ে প্রশ্নটা করলাম।

তিনি বললেন, সুতায় মাঞ্জা দেওয়ার সময় কাঁচের গুঁড়ায় হাতের একটি আঙুল কেটে গেছে। নাটাই অনেক আগেই জোগাড় করে রেখেছি।


অস্থায়ী নিয়োগে খিলগাঁও জোড়পুকুর মাঠে পরিচর্যার কাজ করেন সুরুজ মিয়া। এখন নাটাই বানাতেই দিনের বেশির ভাগ সময় চলে যায় তার। গড়ে প্রতিদিন ১০-১২টি নাটাই বিক্রি করতে পারেন। এর পাশাপাশি ঘুড়ি বিক্রিও চলে। প্রতিটি ঘুড়ি ২০ টাকা। সারা দিনে ২৫-৩০টির মতো বিক্রি হয়।

সুরুজ বলেন, লকডাউনে কাজ বন্ধ। তাই জীবিকার তাগিদে নাটাই বানিয়ে বিক্রি করছেন।

১০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দামের নাটাই আছে সুরুজের কাছে।

তিনি বলেন, "বাঁশের চটি দিয়ে তৈরি নাটাইয়ের দাম কম। কোনো গ্যারান্টি নাই। ৩০০ টাকার ওপরের নাটাই কাঠ দিয়ে তৈরি। পাঁচ বছরেও কিছু হবে না।"


খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে কিছু ভ্যান দেখলাম। তবে আশেপাশে মানুষজন তেমন নেই। একটি রিকশায় করে দুই কিশোর কিছু লাটাই ও ঘুড়ি নিয়ে এলো।

জানতে পারলাম, তাদের মামা এগুলো এনে দিয়েছে। তারা এখন পাইকারি বিক্রি করবে। প্রায় দিনই এভাবে নাটাই ও ঘুড়ি বিক্রি করছে তারা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খুচরা বিক্রেতাদের আসতে দেখা গেল।


গ্রামের ফাঁকা মাঠে বিশাল পরিসরে ঘুড়ি ওড়ানোর সুযোগ থাকলেও শহরে বাড়ির ছাদই ভরসা। স্বল্প জায়গার মধ্যে কোনোমতে নাটাই ধরে বাতাসের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ঘুড়িকে ভাসিয়ে দিতে হয়। অনেকে নিজেরাই ঘুড়ি তৈরি করে থাকেন। হালকা কাগজ, মুলিবাঁশের সরু কাঠি দিয়েই তৈরি করেন বিভিন্ন আকারের ঘুড়ি। গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশবান্ধব কাগজের ঘুড়ির বদলে বৃদ্ধি পেয়েছে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ঘুড়ি আর রেডিমেড মাঞ্জা দেওয়া নাইলনের সুতা।

ঘুড়ি একবার উড়তে শুরু করলে এক সময় তা অনেক উচুঁতে গিয়ে আকাশের বুকে ঠাঁই নেয়। একে একে রঙিন ঘুড়িতে আকাশ ছেয়ে যায়। কেউ একাই ঘুড়ি উড়িয়ে চলেন। আবার কেউ দল বেঁধে মেতে ওঠেন ঘুড়ির খেলায়।


আকাশে-বাতাসে ভেসে থাকা নানা রঙের ঘুড়ির কাটাকুটি খেলায়  অভূতপূর্ব দৃশ্য মনকে চাঙ্গা করছে এই সময়।  সুতো কাটা ঘুড়ি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অজানার উদ্দেশে ভেসে যায়। আগের দিন হলে  ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছু নিতু শিশু-কিশোররা। এখন শিশু-কিশোররাও আগের মত খেলতে যেতে পারে না।

বাতাসে ঘুড়ি উড়িয়ে মনকে হালকা করার এই সময় মনে রাখতে হবে,  ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে অনেক বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তাই  ঘুড়ির পেছনে ছোটা মোটেও উচিত নয়। ছাদের দেয়াল উঁচু না হলে বেখেয়ালে ঘুড়ি উড়ানো যাব না  একেবারেই।  আর এখন সময়টা ভিন্ন বলে,  একটু সতর্ক থাকতে হবে সবাইকেই; অবশ্যই মনে রাখতে হবে সামাজিক দূরত্বের কথা।