প্লেগ মহামারীর দিনে যেমন ছিল ‘লকডাউন’

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 13 May 2020, 12:56 PM
Updated : 13 May 2020, 12:56 PM

সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে কর্তৃপক্ষ প্রথমে রাস্তা ও বাড়ি ঘর থেকে বেওয়ারিশ পশু নিধনের নির্দেশ দেয়। এরপর শুরু হয় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা বা সোশাল ডিস্টেন্সিং। কিন্তু সোশাল ডিস্টেন্সিং দিয়েও কাজ না হলে শুরু হয় সম্পূর্ণ লকডাউন বা জনগণকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা। কিন্তু সে লকডাউন এই লক ডাউন ছিল না। এর বিস্তৃতি ছিল যেমন সর্বব্যাপী তেমনি তার বাস্তবায়নও ছিল কঠিন, কঠোর ও নানা বিবেচনায় নিষ্ঠুর।

ছবি- রয়টার্স

শহরের প্রত্যেক রাস্তার উভয় পাশের বাড়ির বাসিন্দাদের লকডাউন কার্যকর করার জন্য সিনডিক নামের একজন করে সরকারি কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে বাড়ির বাসিন্দাদের বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর বাড়ির বাইরের দরোজায় তালা লাগিয়ে সিনডিক সেই চাবি নিয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা 'ইনটেনডেন্ট' এর অফিসে জমা দেয়। শুরু হয় নগরবাসীদের লকডাউন নামক জেলখানায় বসবাস।

লকডাউনে থাকা মানুষগুলোর বাড়ির বাইরে আসার কোনো অনুমতি ছিল না। তবে তাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকারই গ্রহণ করে। বাড়ির বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় চাল-ডাল, রুটি-রুজি দেওয়া হত তাদের। বাইরে থেকে খাদ্য সরবরাহের  প্রক্রিয়টাও ছিল মজার । বাড়ির কোনো এক স্থানে একটি কাঠের সুড়ং তৈরি করা হত। সেই সুড়ং পথেই দেওয়া হত বেঁচে থাকার জন্য যৎসামান্য উপকরণ।

বাড়ির ভিতরের অধিবাসীরা বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন, কিংবা কেউ অসুস্থ হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনডিক মাঝে মাঝে বাড়ির সবাইকে ঘরের জানালার কাছে আসার নির্দেশ দিত। সিনডিক সবার নাম ধরে ডেকে ডেকে উপস্থিতি নিশ্চিত করত। রোলকলে কাউকে না পাওয়া গেলে সিনডিক মশায় তাকে অসুস্থ কিংবা মৃত বলে ধরে নিতেন । কেউ মারা গেলে তার লাশ দাফন করার জন্য নিম্ন শ্রেণির কিছু লোককে কাজে লাগান হত যাদের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না।

লকডাউন ভেঙ্গে কেউ যদি কোনোভাবে বাড়ির বাইরে আসলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হত। শাস্তির  বিস্তৃতি ছিল নির্জনবাস থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। আজকের দিনের পুলিশের মতো যে সিনডিক নগরবাসীদের গৃহে রাখার দায়িত্ব পালন করত তারাও থাকত কর্তৃপক্ষের তরবারির তলে। সিনডিকরা কোনভাবেই দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করতে পারত না।  দায়িত্ব পালনে অস্বীকারকারী সিনডিকের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

সপ্তদশ শতকের প্লেগপ্রসূত লকডাউনের সাথে একবিশং শতাব্দীর করোনা লকডাউনের পার্থক্য বিস্তর। কিন্তু প্রতিকারহীন মহামারীর বিরুদ্ধে গত চারশত বছরেও লকডাউনের বাইরে কার্যকর কোনো বিকল্প আবিষ্কার হয়নি।

তথ্যসূত্র: ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ- দি বার্থ অব দি প্রিজন, মিশেল ফুকো