ইতালিতে সংক্রমণ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে গেলে সেখানে বাইরে চলাচল সীমিত করতে কঠোর হয় প্রশাসন। ছবি- রয়টার্স
সরকারি বরিশাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে নিজেকে কোথাও যুক্ত করার চেষ্টায় আছি প্রতিনিয়ত।একটি সুযোগও আসে মার্চের শুরুর দিকে। ইন্টারভিউ দেওয়ার ডাক পড়ে ঢাকাতে। ততদিনে করোনাভাইরাস নিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত হতে শুরু করেছে দেশবাসী। সরকার সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে, আইইডিসিআরও সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিয়েছে। তারপরেও কেন যেন মন বলছিল সব ঠিক হয়ে যাবে খুব দ্রুতই। ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগটা নেওয়াই যায় ভেবে পরিবারের অনিচ্ছাসত্ত্বেও চলে এলাম ঢাকায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রিকা মারফত খবর পেতে শুরু করলাম, অবস্থার অবনতি হতে শুরু করেছে। সারা বিশ্বের মত করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে সরকার থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো ২৫ মার্চ থেকে বন্ধ থাকবে সকল অফিস আদালত। যা ধাপে ধাপে এখন ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে।
তারপর শুরু হলো বন্দি জীবন। হয়থ প্রয়োজন ছিল নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার, কিন্তু সবাইকে আরও একবার অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত নিলাম যেখানে আছি সেখানেই থেকে যাবো। পরিবার থেকে বারবার ফোন এলো; ফিরে যেতে বললো তারা। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় তখন মন থেকে সায় মেলেনি। মনে হয়েছিল দীর্ঘ যাত্রা পথে কারো থেকে আমিও হতে পারি কোভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার। আমার থেকে আক্রান্ত হতে পারে আমার পরিবার, আমার এলাকাবাসী।
এখন মাঝে মাঝে যদিও অনুভব করছি, হয়তো সিদ্ধান্তের পুরোটাই ভুল ছিল। আবার মাঝে মাঝে এও অনুভব করি, আমি তো সচেতন, গত চার বছর যাবত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নানা সময় মানুষকে সচেতন করার প্রয়াসে আছি, তবে আমি কেন অসচেতন নাগরিকদের মত সরকারের ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার 'ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন' স্লোগানকে অগ্রাহ্য করে ঘরে না থেকে যাত্রাপথে থাকবো?
তারপর মনে হয়, আমিই ঠিক; আমার জন্য আমি বিপদে ফেলিনি আমার পরিবারকে, আমার গ্রামকে, আমার পরিচিতজনদের। আত্মতৃপ্তি আসে, পরিবার থেকে দূরে থাকার কষ্ট চাপা পড়ে; তখন মনটা ভরে যায়। তখন চিৎকার করে নিজেই নিজেকে বলি, আমিই ঠিক, তোমরা ভুল।
দেশের এমন দুঃসময়ে একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে গুটিয়ে রাখা অনুচিত ভেবে অনলাইন, অফলাইনে নেমে পড়লাম লোকজনকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিতে, ঘরে থাকার উপকারিতা বোঝাতে। পোস্টার, ভিডিও তৈরি করে ফেইসবুক, ইউটিউবে চেষ্টা করেছি মানুষজনকে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে থাকতে অনুপ্রাণিত করতে।
সকল ভয়কে জয় করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতির এই সঙ্কটে সুবিধাবঞ্চিতদের মুখে অন্ন তুলে দিতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে এমন কয়েকটি নিবেদিতপ্রাণ সংগঠনে নিজের সাধ্য অনুযায়ী অল্প অল্প অর্থ সহায়তা করেছি। পাশাপাশি নিজে নিয়ম করে কিছুক্ষণ পর পর হাত ধৌত করছি, ভিড় এড়িয়ে চলছি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করছি, বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করছি।
কিন্তু তাও মনের ভেতর জেগে ওঠা দুশ্চিন্তা কাটাতে ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। অস্থিরতা জাগে যখন বাড়িতে থাকা বাবা-মা, খালা-খালু, ভাই-বোন ও ভাগ্নিদের কথা মনে পড়ে। চেষ্টা করি পরিবারের সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলে নিজেকে একটু হলেও হালকা করতে, হোম সিকনেস দূর করতে।
অপেক্ষা করছি কবে শেষ হবে এ অচলাবস্থার। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আবার কবে বুক ভরে শ্বাস নেব? কবে মুক্তি পাবো? কবে আবার অনুমতি মিলবে নিজের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার? অপেক্ষা যে দিন দিন বাড়ছে।
গত ২৫ মার্চ থেকে পুরোপুরি কোয়ারেন্টিনে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। অনলাইনে সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি, ফ্রিল্যান্সিং, বিভিন্ন অনলাইন কোর্স সম্পর্কে প্রকাশিত বিভিন্ন আর্টিকেল আর ফেইসবুকে চোখ বুলাচ্ছি। সংগ্রহে থাকা পুরনো বই, পছন্দের লেখকদের বইয়ের পিডিএফ কপি, বিভিন্ন অনলাইন কোর্স, রুমের সামনে ছোট্ট জায়গায় রুমমেটকে নিয়ে বিকেলে ক্রিকেট খেলা, সন্ধ্যার পরে হালকা শারীরিক ব্যায়াম অনুশীলন ও রান্না করেই কেটে যাচ্ছে দিন।
সাথে বিডিজবসে চাকরি ও ইউটিউবে নাটক-ছবি দেখা চলছে। নিজের পুরনো ডায়রিতে চোখ বুলিয়ে অতীত স্মৃতি মনে করে আর পুরনো বন্ধুদের সাথে অনলাইন আড্ডায় চেষ্টা করছি দিন পার করতে।
শুরুতে কয়েক ঘন্টা পর পর অনলাইনে চোখ বুলাতাম। নতুন কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলো কি না, কোথায় হলো, কোন দেশে কতজন আক্রান্ত, কোন দেশের মৃত্যুহার কত, কোন দেশ কতগুলো আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করতে পেরেছে, কোন দেশ কতদিনের লকডাউন দিয়েছে জানার জন্য।
কিন্তু এখন খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছি। খানিকটা না বলে পুরোটাই বলা যায়। দিনের পর দিন সুসংবাদের চেয়ে দুঃসংবাদের মাত্রাই বেড়ে চলেছে। প্রায় গোটা দেশ আজ বন্দি। বিরুপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, আন্তজার্তিক যোগাযোগে।
উপলব্ধি করলাম বিশ্বজুড়ে তো আর ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ চলছে না যে ঘন্টায় ঘন্টায় স্কোর দেখতে হবে, এটাতো মহামারী, এটাতো বিপর্যয়। যতটুকু পারা যায় নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে, বাড়িয়ে তুলতে হবে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রাকে। তাই মানসিক চাপ কমাতে চেষ্টা করছি যত পারা যায় করোনাভাইরাস বিষয়ক খোঁজখবর কম নিতে; নিজেকে ও নিজের মস্তিষ্ককে অন্যত্র ব্যস্ত রাখতে।
বিপর্যস্ত পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষগুলো তাদের এ সঙ্কট, উৎকন্ঠা নিশ্চয়ই একদিন পেছনে ফেলবে। অনেক তো হলো পাশাপাশি থেকে একসাথে সব বিপদে লড়াই করা, প্রিয়জনের যত্ন নেওয়া, এবার সময় একটু দূরে থেকেই 'পাশে' থাকার'।