হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, তারপর মৃত্যুর পথে: আলোর দিশা কই

“ফেইসবুকে শত শত বন্ধু; সত্যিকার অর্থে এমন বন্ধু নাই যার সঙ্গে সে তার ভালো মন্দ বিষয় শেয়ার করতে পারে। দেখা গেছে গল্প করছে, আড্ডা মারছে, কিন্তু পার্সনোল বিষয়গুলো অব্যক্তই থেকে যাচ্ছে।”

রাসেল সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2023, 07:32 PM
Updated : 27 April 2023, 07:32 PM

“সেটা অবর্ণনীয় যে, আমি কীসের মধ্য দিয়ে গেছি।… আমি শুধু এই পৃথিবীতে চিরকাল থাকতে চেয়েছিলাম। সেখানে স্থায়ীভাবে যেতে হলে হয়ত দৈহিক দেহের মৃত্যুই একমাত্র সমাধান।” সপ্তাহখানেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ফেইসবুকে এমন পোস্টের পর তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

আরাফাত সিয়াম নামে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের এই শিক্ষার্থী থাকতেন মীর মশাররফ হোসেন হলে; গত ৪ এপ্রিল ওই হল থেকে তার নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়।

এর তিন দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী নাবিল হায়দারের (২৬) মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, ধারণা করা হয় তিনি ‘আত্মহত্যা’ করেছেন।

মৃত্যুর আগে তার ফেইসবুক আইডিতে লেখা হয়েছিল ‘বিদায়’। সহপাঠীরা জানান, বাবার কাছে বাইক কেনার জন্য টাকা চেয়েছিলেন নাবিল। কিন্তু টাকা না পাওয়ায় তার ‘মন খারাপ’ ছিল।

নাবিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন।

পরপর এই দুই ঘটনার পরদিন ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে 'গলায় ফাঁস’ দেওয়ার অবস্থায় রোকেয়া সুলতানা রুকু (২২) নামে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়, ‍যিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন।

অসুস্থতার কারণে কয়েকটি পরীক্ষা দিতে পারেননি রোকেয়া; সেই ‘বিষণ্নতা’র কথা জানিয়ে তিনি কাঁদতেন বলে সহপাঠীরা পরে জানিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে এসব শিক্ষার্থীদের অকাল মৃত্যু বা আত্মহুতির পেছনে কারণ যাই থাকুক, এসব ঘটনা ওই শিক্ষার্থীদের পরিবারে বয়ে আনছে আহাজারি আর অন্ধকার।

মনোবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্তের পেছনে দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরে কার্যকর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের অভাব, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও কাউন্সেলিংয়ের অভাবসহ বিভিন্ন বিষয় কাজ করে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা জরুরি।

‘আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে’ চার বছর ধরে কাজ করা সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, একজন ব্যক্তির আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করে তার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।

 “প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি যখন মেলে না, তখন তার মধ্যে একটা হতাশা চলে আসে। হতাশা যখন অনেক গভীরে চলে যায়, তখন কোনো না কোনো ঠুনকো কারণে আত্মহত্যা করে বসে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তানসেন বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই আত্মহত্যার কারণ একদিনে তৈরি হয় না। কখনও কখনও কয়েক বছর ধরে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ওই সময়ে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা তার সাথে ঘটে। ছোট ছোট ক্ষোভগুলো জমা হতে থাকে, পরে একটা সময় সে আর সেটা নিতে পারে না। তখন এটা বিস্ফোরণ ঘটে আত্মহত্যার মাধ্যমে।”

পরিসংখ্যান কী বলছে

সংবাদমাধ্যমে আসা তথ্যের ভিত্তিতে আঁচল ফাউন্ডেশনের করা এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২২ সালে সারাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্তত ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।

এর মধ্যে ৩৪০ জন বা প্রায় ৬৪ শতাংশই স্কুল পর্যায়ের। কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জনের মধ্যে সমমান মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী গত বছর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার তথ্য উঠে আসে আঁচলের সমীক্ষায়। এর মধ্যে  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২ জন (৬১.৩৯%), মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন (১১.৮৮%), ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন (৩.৯৬%) এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন (২২.৭৭%) শিক্ষার্থী ছিলেন।

আঁচলের হিসাবে সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, যা সবথেকে বেশি। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন মৃত্যুর পথ বেছে নেন।

আত্মহত্যা কেন

২০২০ সালে দেশে কোভিড মহামারীর পর থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে বলে মনে করেন আঁচলের সভাপতি তানসেন।

তার ভাষ্য, “শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে, এটা আমরা গত বছরের রিপোর্টে দেখিয়েছি। এটাতে করোনার একটা ইমপ্যাক্ট আছে। আমাদের পারিবারিক ইস্যু আছে, ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস আছে। সব মিলিয়ে অনেকগুলো নিয়ামক আছে।

“কেউ ডিপ্রেশনে ভুগছে, কিন্তু আত্মহত্যার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু সে যখন দেখছে পাশে কেউ আত্মহত্যা করে বসেছে, তখন কিন্তু তার মাঝে আত্মহত্যার সাহস তৈরি হয়। তখন সে আত্মহত্যা করে।”

তিনি বলেন, “আমাদের সমাজে প্রচুর শিক্ষার্থী আছে, যারা আত্মহত্যাপ্রবণ। আপনারা দেখবেন, যে মাসে আত্মহত্যা বেশি হাইলাইট হচ্ছে, সেই মাসে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। কারণ এটা তার মাঝে এক ধরনের দুঃসাহস তৈরি করে দেয়।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো আত্মহত্যার খবর কিছুটা প্রভাব ফেললেও ঠিক ওই সব খবরে উৎসাহিত হয়েই কেউ আত্মহত্যা করতে পারে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আত্মহত্যার জন্য যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সে তাতে কিছুটা প্রভাবিত হতে পারে। কিন্তু আত্মহত্যার ইচ্ছা যার মধ্যে আগেই ছিল, কারও আত্মহত্যা দেখে কেউ আত্মহত্যা করে ফেলবে, বিষয়টা সেরকম না।

“আত্মহত্যার জন্য যে চিন্তা করছে, স্যোশাল মিডিয়া না দেখেও আত্মহত্যা করতে পারে। স্যোসাল মিডিয়া ছাড়াও তো চিরকুটে আত্মহত্যার নোট লিখে যেত। এখন সেটার বিকল্প হয়েছে স্যোসাল মিডিয়া।”

দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বেই বেড়েছে। কিছু কারণ তো আছেই, কোভিডের একটা ইমপ্যাক্ট আছে। পাশাপাশি সম্পর্কের জটিলতা, অন্যান্য আরও অনেক ইস্যু আছে।

“একেক ব্যক্তির আত্মহত্যার কারণ একেক রকম। জেনারালাইজ করে বলা যাবে না যে এই কারণে সবাই আত্মহত্যা করছে। মানসিক সমস্যার মধ্যে আছে ডিপ্রেশন। জাহাঙ্গীরনগরে যে আত্মহত্যা করেছে, তার মানসিক সমস্যা ছিল।”

পরিবারগুলোতে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের অনুভূতি না বুঝে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় চাপিয়ে দেওয়া হয় বলে মনে করেন অধ্যাপক কামাল উদ্দিন।

“তাদের ফেইলিওরগুলো (ব্যর্থতা) অনেক বেশি হাইলাইট করা হয়। এ বিষয়গুলো যদি বন্ধ করা যায়, আমার মনে হয় কিছুটা হলেও আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, সামাজিক বন্ধন ও সংহতির অভাবে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অপরাধ বিজ্ঞানী ট্রাভিস হারশি স্যোসাল বন্ডিংয়ের থিওরি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, চারটি উপাদান যদি মানুষের মধ্যে থাকে, তাহলে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বিচ্যুতিমূলক আচরণ কমে যায়। সেগুলো হল অ্যাটাচমেন্ট, ভালো কাজে ইনভলভমেন্ট, কমিটমেন্ট ও বিলিফ। এই চারটা উপাদানকে তিনি বলেছেন সামাজিক বন্ধন তৈরির উপাদান।

“সুইসাইডের তত্ত্ব দেওয়া এমিল ডুর্খেইম বলেছেন, সামাজিক সলিডারিটি না থাকলে বিচ্যুতিমূলক আচরণ ঘটে। যার সর্বোচ্চটা হচ্ছে সুইসাইড। সোশাল বন্ডিং ও সলিডারিটি জিনিস দুটো একই। যখন সামাজিক আচরণের মধ্যে থাকা হয়, আর সেগুলো থেকে যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন আর এই বন্ডিং বা সলিডারিটি থাকে না। তখন ভালো-খারাপ চিন্তা করার মত তার বোধ থাকে না।”

আজকের সমাজ যে দ্রুত একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে জিয়া রহমান বলেন, “ট্রান্সফরমেশনের একটা ট্রানজিশনাল ফেজের মধ্যে আছি আমরা। এখনও আমাদের উত্তরণ পর্বটা পুরোপুরি হয়নি। আমরা একটা সনাতনী সমাজ থেকে আধুনিক সমাজের দিকে যাচ্ছি। আমাদের সমাজে এখনও ট্র্যাডিশনাল মূল্যবোধগুলো রয়ে গেছে। আধুনিক মূল্যবোধেও আমরা পুরোপুরি যেতে পারিনি। সেই কারণে আমি বলছি ট্রানজিশন।

“আগের দিনের অনুশাসনগুলো এখন আর নাই। আধুনিক সমাজের নৈতিক উন্নয়নের জন্য যে ইনস্টিটিউশন থাকা দরকার, আমাদের সেগুলোও নাই। আমরা একটা অস্থির সময়ে বাস করছি। আমাদের অনুশাসনগুলো আলগা হয়ে গেছে। নতুন কোনো অনুশাসনও আমরা দিতে পারি নাই। এখনও ট্রানজিশনের পর্যায়ে আছি।”

করণীয় কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, উন্নত বিশ্বে তরুণদের হতাশা ও বিষণ্ণতা থেকে দূরে রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বাংলাদেশে সেই চর্চা এখনও নেই।

“উন্নত বিশ্বে বিকল্প ইনস্টিটিউশন তৈরি হয়েছে, যেমন সাপোর্ট সিস্টেম, ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজ। ইয়াং ছেলেমেয়েদের যখন সামারে ক্লাশ শেষ হয়, তাদের ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজের মধ্যে চার মাস কাজ করে, তারা একটা মিনিমাম টাকা পায়, সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। চাকরির ক্ষেত্রে সেটা আবার কাজে লাগে।

“পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেও মানবিক গুণাবলী ডেভেলপ করার চেষ্টা করেছে তারা। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের জন্য তারা কমিউনিটি লাইব্রেরি করছে। পরিবারের আদলে ডে কেয়ার তৈরি করেছে।”

এই শিক্ষক বলেন, “আমাদের দেশে এধরনের অ্যাক্টিভিটিজ নেই। রাষ্ট্র বা সমাজ এমন আইন তৈরি করে নাই বা এমন সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করে নাই। এমনভাবে মোটিভেট করতে পারে নাই যে, একটা মেয়ে বা ছেলে যদি ভিক্টিম হয়, তাকে দ্রুততার সঙ্গে সাপোর্ট দেওয়া যায়।”

ফেইসবুক বা স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে ‘অবসেশন’ বা ঘোর তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

“পড়ালেখা বাদ দিয়ে তরুণরা ফেইসবুকে সময় কাটাচ্ছে। কালচারাল ও কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ নাই, যেটা মানুষের মননশীলতার উন্নয়নে সহায়তা করে। অবসেশনে থাকার কারণে স্টেবল থাকার নিয়ামকগুলোর অভাব থাকছে। ফলে তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা কাজ করছে, ড্রাগ এডিক্ট হয়ে পড়ছে।

“অবসেশন ও হতাশার কারণে স্যোসাল বন্ডিং কমে যাচ্ছে, তার মধ্যে সংহতি কমে যাচ্ছে, সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, চূড়ান্ত পর্যায়ে সে সুইসাইড করছে।” 

শুনতে হবে তাদের কথা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, একজন মানুষের আত্মহত্যার পেছনে অনেকগুলো ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করে।

“এতদিন মানুষ শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই সচেতন ছিল। কিন্তু কোভিড পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে সারা বিশ্বেই আমাদের তরুণ সমাজে ডিপ্রেশন, স্ট্রেস, একাকীত্ব– এগুলো ভয়ঙ্কর পরিমাণে বেড়ে গেছে। মানসিকভাবে মানুষের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে।

“মানুষের ধৈর্য ক্ষমতা, প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক অবস্থা এ সমস্ত কিছু মনের উপরে প্রভাব ফেলছে। এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই দিকগুলোতে আমাদের নজর দেওয়া কতখানি জরুরি।”

পারিবারিক বন্ধনগুলো এখন ‘খুবই এলোমেলো হয়ে গেছে’ বলে মনে করেন অধ্যাপক মেহজাবীন।

“পরিবারের কে কী করছে, সেটার খোঁজ-খবর নেই। মানসিক সাপোর্ট পাওয়ার যে ব্যাপারটা, এটা যদি না থাকে সেটা আত্মহত্যার একটা বড় কারণ। ফেইসবুকে শত শত বন্ধু; সত্যিকার অর্থে এমন বন্ধু নাই যার সঙ্গে সে তার ভালো-মন্দ বিষয় শেয়ার করতে পারে। দেখা গেছে গল্প করছে, আড্ডা মারছে, কিন্তু পার্সনোল বিষয়গুলো অব্যক্তই থেকে যাচ্ছে।”

এই মনোবিদ বলেন, দেখা যায় হতাশা আর বিষণণ্নতা থেকে যারা বিচ্ছিন্নতার মধ্যে চলে যাচ্ছে, নিজের মনের কথা বলার মত কাউকে তারা পাচ্ছে না।

“সে যদি কথাগুলোও বলতে পারে, অন্তত ওই মুহূর্তে সে এ ধরনের পদক্ষেপ নেবে না। কেউ যদি আত্মহত্যা করতে চায়, সে কিন্তু নানাভাবে সেটা জানান দেয়। সেগুলোকে হালকাভাবে না নিয়ে মনোযোগ সহকারে তার কথাগুলো শোনা হলে এই ঘটনাগুলোর হার কমে যাবে।

“কেউ ফেসবুকে সন্দেহজনক স্ট্যাটাস দিলে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের খোঁজ খবর রাখতে হবে, জানতে হবে তার মনে কথা।”

আঁচল ফাউন্ডেশনের তানসেন রোজও মনে করেন, মন খুলে কথা বলার জায়গা পাচ্ছে না বর্তমানে সমাজের তরুণরা।

“একটা মানুষ যখন ডিপ্রেশনে ভোগে, তখন যদি সে শেয়ার করার একটা জায়গা পায়, তখন কিন্তু হয়ত আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসার সুযোগ আছে। আমরা তাদের এই প্ল্যাটফর্মটা দিতে পারছি না।

“শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই জায়গাগুলো দিচ্ছেন না। ফলে দেখা যায়, তার মনে ক্ষোভগুলো প্রশমিত করার কোনো জায়গা নেই। আমাদের এমন স্পেস দরকার, যারা ইমপ্যাথিকালি (সমানুভূতির সঙ্গে) ওই মানুষটার কথা শুনবে। সেটা হতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সেন্টার। ছয় মাস অন্তর অন্তর প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর কাউন্সেলিং দরকার। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা থাকলেই কাউন্সেলিং করতে হবে বিষয়টা এমন না। প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে এমন প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার, যেখানে অন্তত ছয় মাসে শিক্ষার্থীর কথা শুনবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষার্থী উপদেষ্টা থাকলেও তা কার্যকর নয় বলে মনে করেন তানসেন। তিনি বলেন, সেই শিক্ষককে স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার হিসেবে নেওয়া দরকার, যিনি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানেন, বোঝেন এবং অন্যের প্রতি যিনি সহানুভূতিশীল, শিক্ষার্থী-বান্ধব।

“শিক্ষার্থীরা যদি স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারের সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করে, তাহলে তো কোনো লাভ নেই।”

তিনি বলেন, “আমাদের যে সাইকোলজি বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট আছে, সেখানকার টিচারদের কিংবা ইন্টার্ন শিক্ষার্থীদের দিয়ে যদি শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো শোনার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো যাবে বলে মনে করি।”

আরও পড়ুন-

Also Read: এক বছরে ৫৩২ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, সমাধান কোন পথে?