নিপীড়নের অভিযোগ জানাতে যত নারী গত এক বছরে জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে ফোন করেছেন, সেই সংখ্যা এ বছর পেরিয়ে গেছে আট মাসেই।
Published : 19 Sep 2022, 01:03 AM
“মেয়ে মানুষ, রাতের বেলায় বাসায় যাওয়ার চিন্তা করেন?” গণ পরিবহনে হঠাৎ বাজে ইঙ্গিত করে এমন কথা শুনে চটেছিলেন সাদিয়া সাকি। কিন্তু সে ঘটনার কোনো প্রতিকার তিনি পাননি।
“কথাটা শুনেই তো আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি আমার ফ্রেন্ডদেরকে ফোন করা শুরু করলাম। তখন বাসটা আমায় দ্রুত নামায়ে দিয়ে চোখের পলকে চলে গেছে।”
রোজ সাভার থেকে বসিলার এক বাসায় টিউশনে যেতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্রী সাদিয়া। একদিন টিউশন থেকে বেরিয়ে সাভারগামী বাসে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে ২০২১ সালের সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “ততক্ষণে চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আমি তখন ঘরে ফেরার সময় গুণছি।”
কিন্তু সাকি তার ঘর, অর্থাৎ ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর আগেই ‘বাড়তি ভাড়া’ দাবি করার প্রতিবাদে বাস চালকের সহকারীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
সাকি আফসোস করে বলেন, “বন্ধুরা আসতে আসতে দেরি হয়ে যাওয়ায় সেদিন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি।”
কিন্তু এই কিছুদিন আগে তিনি আবারও একটি লোকাল বাসে একই ধরনের হয়রানির শিকার হয়ে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এ কল দিয়েছিলেন।
“যখন তেলের দাম বাড়লো, তখন হইছে এটা। আমি একটা টিউশন শেষ করে মোহাম্মদপুর থেকে শিশুমেলা যাচ্ছিলাম। তখন প্রায় ৮টা বেজে গেছে। বাসওয়ালা বলল, ৮টার পরে স্টুডেন্ট ভাড়া নেবে না। এ নিয়ে খুব গ্যাঞ্জাম লাগল।
“আশপাশের লোকজন আমায় বলতেছিল, আপা চুপ থাকেন। তখন আমি ৯৯৯ এ কল দিলাম। আমার থেকে তারা বাসের নম্বর নিল। তারপর তারা হাফ ভাড়াই নিছে এবং বাড়তি টাকা ফেরতও দিছে।”
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে যে ধরনের ফোন আসে, সেই তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারীকে হয়রানি, নিপীড়ন, আর সহিংসতার অভিযোগ জানাতে বা সাহায্য চেয়ে ফোন কলের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে।
এ বছর অগাস্ট পর্যন্ত এ ধরনের কল এসেছে মোট ১৩ হাজার ৪১৬টি, যেখানে ২০২১ সালে পুরো বছর মিলে এমন কলের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ১৬৯টি।
আরও পেছনে তাকালে দেখা যায়, জরুরি সেবার এ হটলাইন চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিবছরই নারীদের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালে কোভিড মহামারী শুরুর পর নারীদের ফোন কলের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হয়। পরের বছর তা ফের দ্বিগুণ হয়ে ১২ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
৯৯৯ এর কল সংখ্যা পর্যালোচনা করে পাওয়া এই তথ্য এ সংক্রান্ত পুরনো জরিপের তথ্যকেও সমর্থন করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, বিবাহিত নারী এবং মেয়েদের ৭০ শতাংশের বেশি তাদের পুরুষ সঙ্গীদের মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে পীড়নের শিকার হয়েছেন। সেই জরিপের উত্তরদাতা অর্ধেক নারীই সঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
সে প্রসঙ্গ ধরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, “হেল্পলাইনগুলি আসছে, সেগুলি ব্যবহার করতে পারতেছে। সেটা একটা ভালো দিক। কিন্তু ঘটনাটা তো ঘটতেছে। আর ৯৯৯ এ মাত্র ১৩ হাজার জন জানাইছে। কিন্তু এরকম তো আরও হেল্পলাইন আছে।”
তিনি বলছেন, ৯৯৯ এ কল করে সহায়তা চাওয়ার মত প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং মনোবল অনেক নারীর এখনও নেই। তাই অনেক সহিংসতার ঘটনা এখনো অভিযোগের খাতায় আসছে না।
কোন ধরনের কল বেশি আসে?
নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় সারাদেশ থেকে গত পাঁচ বছরে ৯৯৯ এ যত কল এসেছে, তার মাঝে ১০ হাজার ২০৭টি ছিল অত্যাচার সংক্রান্ত। এর মাঝে ২০২২ এর প্রথম আট মাসেই এসেছে ৩ হাজার ৫৫২টি কল, গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২৯২টি।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, গত পাঁচ বছরে শুধু স্বামীর হাতে নির্যাতনের অভিযোগই এসেছে ৯ হাজার ৩১৩টি। এর ৪৫ শতাংশই এসেছে এ বছরের প্রথম আট মাসে।
২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের ঘটনায় মোট কল এসেছে যথাক্রমে ৫ হাজার ৭৭০টি এবং ২ হাজার ৬৬৯টি।
সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিড নিক্ষেপ এবং যৌতুকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। তারপরও এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়নি।
গত পাঁচ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় ৪০টি এবং যৌতুকের প্রতিকার চেয়ে ৮৬৩টি কল এসেছে ৯৯৯ এ।
জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে এ বছর অগাস্ট পর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট কল এসেছে ৫৫ লাখ ১৫ হাজার ৯৯৪টি। গতবছর এ সংখ্যা ছিল ৯১ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৭টি।
আর ২০১৭ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২২ এর অগাস্ট পর্যন্ত মোট কল এসেছে ৪ কোটি ৪ লাখ ২১ হাজার ৪৩৫টি। এসব কলের মাঝে ৫৯ দশমিক ২৫ শতাংশই ছিল ‘প্র্যাংক’ ও ‘ব্ল্যাংক’ কল।
যে কলাররা সত্যিই সেবা পেতে কল করেছিলেন, তাদের মাঝে পুরুষের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে শিশু এবং সবচেয়ে কম কল করেছেন নারীরা।
সহায়তা চেয়ে কল বাড়ছে কেন?
জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) তবারক উল্লাহ বলেন, “অপরাধ বাড়ছে কি না (এই সংখ্যা থেকে) তা বলতে পারব না, সচেতনতা বাড়ছে কি না সেটাও আমি জানি না।
“তবে এটা বলতে পারব যে, জনগণের ৯৯৯ এর প্রতি আস্থা বাড়ছে। যে কারণে মানুষের মাঝে এটি ব্যবহার করার প্রবণতাও বাড়ছে।”
করোনাভাইরাস মহামারীর সময় কোনো ধরনের প্রচার ছাড়াই রেকর্ড সংখ্যক কল পাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তখন কিন্তু আমরা একবারও পত্র-পত্রিকায় বলিনি যে আপনারা ৯৯৯ এ কল দেন।
“সরকারের তরফ থেকে, বিভিন্ন ফোকাল পয়েন্ট থেকে বলা হয়েছে, ১৬২৬৩ (স্বাস্থ্য সেবা) অথবা ৩৩৩ (খাদ্য সহায়তা) তে ফোন দিন। কিন্তু তারপরও যে পরিমাণ কল আসছে, তা মানুষের বিশ্বাস থেকেই আসছে।”
কোভিড মহামারীর শুরুর দুই মাস, অর্থাৎ মার্চ ও এপ্রিলে ৯৯৯ এ সবচেয়ে বেশি কল এসেছে। ২০২০ এর মার্চে ১০ লাখ ২৯ হাজার ২৯৬টি এবং এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ৫ হাজার ৭১২। এরপর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।
অভিযোগ পেলে কীভাবে সহায়তা দেওা হয় জানতে চাইলে ডিআইজি তবারক বলেন, “যদি ঠাকুরগাঁও থেকে কেউ কল দিয়ে বলে আমি নিগ্রহের শিকার হচ্ছি, তখন আমরা তার থেকে জানব যে, লোকেশনটা কোথায়। তারপর আমরা ঠাকুরগাঁও সদর থানায় ফোনটা কানেক্ট করিয়ে দেব। আমার কাজ এটুকুই।
“এরপরে সেখানে পুলিশ যাওয়ার পরে সেটা মামলা হবে নাকি জিডি হবে, নাকি গ্রেপ্তার করবে, এগুলো আমার বিষয় না। ওই সিটিজেনের কাছে তৎক্ষণাৎ পুলিশকে নিয়ে যাওয়াই হল আমার কাজ।”
৯৯৯ এর পুলিশ পরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) আনোয়ার সাত্তার বলেন, পুলিশি সহায়তা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর ৯৯৯ থেকে আবার কলারকে কল করা হয়, সমস্যার সমধান হয়েছে কি না তা জানতে।
“এসব কারণেই হয়ত মানুষ আমাদেরকে ভরসা পাচ্ছে। কিন্তু সেজন্য এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, অপরাধ বাড়ছে।”
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, এখন অনেকে অভিযোগ জানাচ্ছেন ঠিক, কিন্তু অনেকে এখনও সে সুযোগ বা সাহস পাচ্ছেন না।
“অভিযোগ করলে পরে তার একটা রেমেডি হয়। কিন্তু এটা যদি হয় যে আমি অভিযোগ করলাম, আর তারপর আমার ওপর সহিংসতা বেড়ে গেল, তাহলে তো হবে না। তবে এটা ভালো যে, এখন একটা মেয়ের অভিযোগ করার জায়গা আছে।
“তার পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে, পুলিশ প্রশাসন দাঁড়াচ্ছে। এতদিন ধরে আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের ক্ষমতা তো রাষ্ট্রের মত না। আমাদের সবসময়ই দাবি ছিল রাষ্ট্রের এজেন্সিগুলা যেন এগিয়ে আসে।”
সরকার ২০১০ সালে যে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন পান করেছিল, মালেকা বানুর ভাষায়, তা ‘খুবই প্রগ্রেসিভ’ একটি আইন, কিন্তু ‘দুঃখজনক হল’ এর ব্যবহার নেই।
সহিংসতায় শাস্তি দেওয়ার চেয়ে সহিংসতা যাতে না হয়, তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “এই আইন শাস্তি দেওয়ার জন্য না। এটার প্রয়োগ করলে সংসার ভাঙবে না। বরং, কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সংসারের মাঝে থাকা যায়, সেটা বোঝা যাবে। কিন্তু কেন যেন এইটার কোনো প্রচার নাই। যারা বাস্তবায়ন করবে, তারাও এর ব্যবহার জানে না। তাদের প্রশিক্ষণের দরকার।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবারকেন্দ্রিক বিষয়গুলোর দিকে রাষ্ট্রের কঠোরভাবে নজর দেওয়া উচিত।
“আজকে আমরা দেখছি বাবা মাকে সহ্য করতে পারছে না। বাবা মেয়েকে অ্যাবিউজ করছে। ঘরের মাঝে এমন সব অকল্পনীয় ঘটনা যে ঘটে যাচ্ছে, এগুলার কোনোটা সামনে আসছে, কোনোটা আসছে না।
“কিন্তু ঘটনা যে ঘটে যাচ্ছে। হাতে গোণা অল্প সংখ্যক মানুষ হয়ত ৯৯৯ এ কল দেয়। এর মূল কারণ হল আমাদের মানবিক গুণাবলী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্যারেন্টিং এবং বিয়ে সম্পর্কে তিনি বলেন, “আপনি একটা পরিবারের মাঝে যত বেশি ভালোবাসা, বন্ডিং, ভালো রিলেশনশিপ দেখবেন, সেই পরিবারে ভায়োলেন্স কম পাবেন।”
“আমার কথা শুনে মনে হবে, আমি অনেক ব্রডার স্কেলে কথা বলছি। কিন্তু না, জায়গাটা একটাই, ফ্যামিলি। কারণ এটা ফান্ডামেন্টাল কারখানা।”
সামাজিক বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই শিক্ষক বলেন, “আপনি দেখেন যে একটা ঝড় আসতেছে, কোভিড আসতেছে; বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। কারণ মেয়েদের সর্বশেষ গন্তব্য হলো বিয়ে। পরিবার তাকে অনুভব করায় যে তুমি বোঝা।
“তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এরকম ডিমান্ড ক্রিয়েট করা উচিত যে, তুমি তখনই সন্তান নিবা যখন সন্তানটাকে পরিপূর্ণভাবে খাওয়াতে পারবা এবং এত বছর পর্যন্ত পড়াতে পারবা। এই বেসিক কাজটা করতে পারলে এই সহিংসতার পরিমাণ বহুলাংশে কমে আসবে।”