স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ নেই ২১ জেলার ৬১ উপজেলায়

অনেক উপজেলায় এখনও স্বাধীনতা দিবসে ফুল দিতে হয় ভাষা শহীদ মিনারে।

শাহরিয়ার নোবেলনিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2023, 07:30 PM
Updated : 25 March 2023, 07:30 PM

যে স্তম্ভ বহন করে দেশ স্বাধীনে লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, যেখানে মানুষ খুঁজে পেতে চায় তার হারানো স্বজনকে; স্বাধীনতার অর্ধশতকের বেশি সময় পেরিয়েও সেই স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠেনি দেশের ২১ জেলার প্রায় অর্ধেক উপজেলায়।

এসব উপজেলায় স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানানোর একমাত্র স্থান হল ভাষা শহীদ মিনার।

২০১৮ স্বাধীনতা দিবসের আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছ থেকে ঘোষণা এসেছিল, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দেশের সব জেলা-উপজেলায় স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হবে।

কিন্তু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে সেই ঘোষণার পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। ২১টি জেলার ১৪২ উপজেলার মধ্যে ৬১টিতে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের ভাষ্য, স্মৃতিস্তম্ভ না থাকলে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা শহীদ দিবস এবং স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার হবে না।

সেইসঙ্গে গণকবর সংরক্ষণ এবং সেখানে নাম ফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদও এসেছে গবেষকদের কাছ থেকে।

এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে কাজ করা কবি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জয়দুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দেব। কিন্তু ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বেরে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ হারানো শহীদের স্মরণে সব উপজেলা ও স্কুল-কলেজে স্মৃতিস্তম্ভ থাকা উচিৎ। তা না হলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে।”

উপজেলা পর্যায়ে স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পরিকল্পনা আছে। কাজ শুরু করি নাই, শুরু করবো। ভাষা শহীদের জন্য শহীদ মিনার আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ থাকবে।”

২১ জেলার চিত্র

২১ জেলার মধে নাজুক অবস্থায় পাওয়া গেল ঢাকা বিভাগের তিন জেলা মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ীকে। এই তিন জেলায় সদর উপজেলা ছাড়া অন্য উপজেলাগুলোতে শহীদ মিনার থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মরণে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়নি।

মাদারীপুরের গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে জমি অধিগ্রহণ সমস্যা তুলে ধরেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ও বধ্যভূমির স্মৃতি রক্ষার্থে বেশকিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কয়েকটিতে জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজ শুরু করতে দেরি হচ্ছে। বাকিগুলোতে কাজ শুরু হয়েছে।”  

শরীয়তপুরের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জানে আলম জানান, সদর ছাড়া আর এই জেলার আর কোথাও মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

“আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সদরেরটির সংস্কার কাজ হচ্ছে।”

অথচ পাশের জেলা গোপালগঞ্জের তিন উপজেলাতেই স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এমন ইতিবাচক চিত্র আছে মেহেরপুর জেলাতেও।

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বলেন, “মেহেরপুরের এই চিত্রটি ইতিবাচক। তবে আমি বলব না যে আমরা অনেক কাজ করেছি বলে এটা হয়েছে। সদরে তো স্মৃতিস্তম্ভ থাকেই। আর মুজিবনগর আপনারা জানেন আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানে অনেককিছু আছে। আরেকটি উপজেলা বাকি থাকে গাংনি, সেখানেও শহীদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ আছে।”

স্মৃতিস্তম্ভ কম থাকার তালিকায় আরও আছে পিরোজপুর, বান্দরবানও।

আগরতলা সীমান্ত ঘেঁষা ব্রাহ্মণাড়িয়া জেলা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জেলাটিও একটি ইতিবাচক মডেল হয়ে উঠতে পারত, তবে সেই যাত্রায় বাদ সেধেছে সরাইল উপজেলা। এই জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে শুধু সরাইল স্মৃতিস্তম্ভশূন্য।

এ নিয়ে দুঃখ আছে সরাইল পাইলট বালিক উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী নুসরাতের। এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, “আমাদের উপজেলায় শুধু শহীদ মিনার আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, সব দিবসে আমরা শহীদ মিনারেই ফুল দেই। এখানে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের জন্য কিছু করা নাই।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গবেষক জয়দুল হোসেনের দাবি, শুধু স্মৃতিসৌধ নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমির সংরক্ষণ প্রয়োজন।

তিনি বলেন, “ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রায় ৬৫০টি গণহত্যার স্থান, গণকবর, নির্যাতনকেন্দ্র আমি পেয়েছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বড়জোড় ১০-১৫টি স্থান সংরক্ষণ হয়েছে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।”

করণীয় কী?

স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পাশাপাশি দেশের নানা প্রান্তের গণকবর সংরক্ষণ করার জরুরি বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি প্রাবন্ধিক ও গবেষক মফিদুল হক। পাশাপাশি নামফলক নির্মাণ করাও প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

এই কাজে স্থানীয় সমাজকে যুক্ত করার পরামর্শ রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের এই গবেষক। 

মফিদুল হক বলেন, “যেখানে এসব স্মৃতিচিহ্ন আছে সেখানকার সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু মিনার বানালে হবে না, সমাজকে এর মধ্য যুক্ত করলে সবার মধ্যে স্বাধীনতার সেই বোধ ও চেতনা তৈরি হবে।”

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরর ডটকম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় বধ্যভূমি এবং টর্চার সেলের স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে অবশ্যই স্মৃতিস্তম্ভ হওয়া উচিৎ।  

“মুক্তিযুদ্ধের কথা, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা এমন এক সময়ে আমরা বলছি যখন পাকিস্তানিরা ১৯৭১ আত্মসমর্পণ করলেও তাদের ছিটমহল রয়ে গেছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাকে আঘাত করছে। কাজেই নতুন প্রজন্মের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসের চিত্র দেখাতে হলে সব জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ হওয়া উচিৎ।”

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তরুণ প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চর্চা গড়ে তোলার উদ্দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।