পাঁচ বছর আগে এলাকায় সমিতির কার্যক্রম বন্ধের পর তার বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা হয়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল ৩৬টি।
Published : 19 Oct 2022, 07:02 PM
গ্রাহকের অর্ধশত কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে কুষ্টিয়ার জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রধান খন্দকার আবুল কালাম আজাদকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
ঢাকার উত্তরা থেকে গত মঙ্গলবার রাতে তাকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার সংবাদ সম্মেলনে আজাদের প্রতারণার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, সমবায় সমিতির নামে প্রথমে কুষ্টিয়ায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করে আজাদের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি। পরে খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীতে এর পরিসর বাড়ানো হয়। সবশেষ পাঁচ বছর আগে এসব এলাকায় অফিস গুটিয়ে ঢাকায় চলে আসার সময় গ্রাহকদের আমানতের পরিমাণ ছিল ৫০ থেকে ৭০ কোটি টাকা এবং গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রাহকদের আত্মসাৎ করা অর্থ আজাদ আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ঠিকানা লিভিং লিমিটেড নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির নামে কুষ্টিয়াতে ১৫ বিঘা জমি, একটি ছয় তলা ভবন, ইটের ভাটা এবং রাজশাহীতে ১১ বিঘা জমি কেনেন।
ঢাকার উত্তরায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট ও গাড়ি কিনেছেন তিনি। এছাড়াও নামে-বেনামে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে প্রচুর সম্পদ গড়েছেন।
সমিতির কার্যক্রম গুটিয়ে পাঁচ বছর আগে এলাকা থেকে চলে এলে বিভিন্ন জেলায় গ্রাহকরা বিক্ষোভ করলেও তারা টাকা ফেরত পাননি।
চেক জালিয়াতি ও প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় দায়ের করা ৬০টি মামলায় ৩৬টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে উত্তরায় বাড়ি কিনে ঢাকায় থিতু হন তিনি। পাঁচ বছর ধরে গ্রাহকরা টাকার দাবিতে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ করলেও গ্রেপ্তার এড়িয়ে ছিলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, ২০০৩ সাল থেকে জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান খোলেন আজাদ। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করেন। এভাবে ২০১২ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে আরও বড় পরিসরে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীতে কার্যক্রম শুরু করেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সহজ শর্তে ব্যবসায়ীদের জন্য মোটা অঙ্কের ঋণ ও প্রান্তিক মানুষকে ক্ষুদ্র ঋণ দিত সংস্থাটি। গ্রাহকেরা ‘তফশিলি ব্যাংক’ মনে করে তার প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখতে শুরু করেন। অনেক ব্যবসায়ীকে সমিতিটি থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়ায় এলাকায় নামও হয়। জেলা শহরগুলোতে দৃষ্টিনন্দন বাড়ি ভাড়া নিয়ে চাকচিক্যময় অফিস খুলতেন তারা।
মূলত আজাদ, তার স্ত্রী, ছোট ভাই এবং ভাইয়ের স্ত্রী মিলে সমিতিটি চালাচ্ছিলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা কয়েক হাজার গ্রাহক জুটিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করেন বলে র্যাবের মুখপাত্র জানান।
তিনি জানান, ২০১৭ সালে সমিতির গ্রাহক সংখ্যা সাত থেকে আট হাজার হয়। তারা ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত রাখেন। আজাদের দেওয়া হিসাব মতে, ওই বছর পর্যন্ত তার কাছে গ্রাহকদের সঞ্চয়-আমানতের পরিমাণ দাড়ায় ৫০ থেকে ৭০ কোটি টাকা।
পরে ২০১৭ সালে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে আজাদ আঞ্চলিক সব অফিস গুটিয়ে এবং সব ফোন নম্বর একযোগে বন্ধ করে দিয়ে ঢাকার উত্তরায় এসে গা ঢাকা দেন বলে জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, পালানোর সময় মাঠপর্যায়ে তার প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মাঠ পর্যায়ে অর্থ সংগ্রহের জন্য আজাদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় আটশতাধিক কর্মী ছিলেন যাদের বেতন দেওয়া হত না। সংগৃহ করা আমানত থেকে একটা কমিশন দেওয়া হত তাদের।
সমিতির টার্গেট গ্রুপ ছিল দিনমজুর, চায়ের দোকানদার, মুদি দোকানদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ। গ্রাহক বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে বিশেষ প্যাকেজ ও প্রণোদনা ঘোষণা করতেন। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতই গ্রাহকদের আমানত সংগ্রহ ও ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন।
গ্রাহকদের তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, সমিতিটি ৫০ থেকে ৭০ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত সংগ্রহ করেছিল, যা আরও বেশিও হতে পারে।