ইংরেজিতে লিখি, কারণ এতে আমি ‘স্বচ্ছন্দ্য’: গুরনাহ

‘মায়ের কাছে চিঠি লেখা ছাড়া বাকি সবকিছু ইংরেজিতে লেখা ছিল আমার কাছে সহজতর’, বলেন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তানজানিয়া বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এ লেখক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2023, 03:53 PM
Updated : 8 Jan 2023, 03:53 PM

আন্তর্জাতিক পাঠক ধরার জন্য নয় বরং নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের কারণেই ইংরেজি ভাষাতে লেখালেখি করার কথা বলছেন নোবেল সাহিত্য পুরস্কারজয়ী লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ।

লেখার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নেওয়ার কারণ বিষয়ক এক প্রশ্নে রোববার ঢাকা লিট ফেস্টের এক অধিবেশনে এমন উত্তর দেন তানজানিয়া বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এ লেখক।

২০২১ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী গুরনাহ বলেন, “আমি কোন ভাষায় লিখব তা নিয়ে চিন্তা করছি কিংবা ইংরেজিতে লিখলে আন্তর্জাতিক পাঠক পাওয়া যাবে- এমন বিষয় আমার ক্ষেত্রে কখনও ঘটেনি।

“এসব আমার কাছে কোনো বিষয় ছিল না বা আমার ক্ষেত্রে ঘটেওনি। ইংরেজি এমন একটা ভাষা যাতে আমি স্বচ্ছন্দ্য ছিলাম। সেটাতেই আমি লেখা চালিয়ে গেছি এবং এখনও আমি তেমনই অনুভব করি।”

ইংরেজিতে সাবলীলভাবে লেখার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “ভাষা নিয়ে কোনো ধরনের চিন্তা না করেই আমি ইংরেজিতে লিখতে পারি। আমি লেখার সঠিক সমন্বয় পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি যত্নবান ছিলাম। এভাবেই চলছে, এটা একটা ভাগ্য।”

এদিন ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে দশম এ সাহিত্য আসরের শেষ দিনে ‘ডেজার্শন’ শীর্ষক অধিবেশনে নিজেদের বেড়ে ওঠার গল্প শোনানোর পাশাপাশি লেখক হয়ে ওঠার পথচলা তুলে ধরেন গুরনাহ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন গুরনাহ এর বিভিন্ন বইয়ের সম্পাদক ও ব্রিটিশ প্রকাশক আলেকজান্ড্রা পিঙ্গেল।

আগের দিন শনিবারও নিজের লেখালেখি এবং সাহিত্য নিয়ে কথা বলেন নোবেল বিজয়ী এ লেখক ও সাহিত্যের শিক্ষক।

গুরনাহর জন্ম ১৯৪৮ সালে তানজানিয়ার জানজিবারে, যে দেশ পর্তুগিজ, ওমান ও ব্রিটিশ শাসনে ছিল কয়েকশ বছর। তার গল্পের অনেক চরিত্রের মত তিনি নিজেও একজন শরণার্থী হয়ে ১৯৬০ এর দশকে ইংল্যান্ডে পা রাখেন।

তার পরের জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বশেষ সেখানে তিনি ইংরেজি আর পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন।

রোববার অনুষ্ঠানে লেখার ভাষা বেছে নেওয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জানজিবারে স্কুলে পড়ার সময় এক শিক্ষক তার ইংরেজিতে দক্ষতার কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করেন গুনরাহ।

ইংরেজির সঙ্গে তার এক ধরনের ‘বন্ধনের’ কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “শিশুকালে স্কুলেও আমি ইংরেজিতে ভালো করেছিলাম। এটা এমন দক্ষতা, যা আমার মধ্যে ছিল।

“আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমি ইংরেজিই পড়ছিলাম, ইংরেজি বই পড়ছিলাম। পড়া ও লেখার মধ্যে অন্তরঙ্গ সংযোগ আমরা সবাই জানি। আমার মনে হয়, যখন আমি লিখতে আসি, তখন ইংরেজিতে লেখাই ছিল আমার জন্য সহজ। মায়ের কাছে চিঠি লেখা ছাড়া বাকি সবকিছু ইংরেজিতে লেখা ছিল আমার কাছে সহজতর।”

খুব ছোটো বেলায় জানজিবার বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজ ও তাতে চড়ে আসা নানা ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের জীবনাভিজ্ঞতা দেখার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।

গুরনাহ বলেন, বিভিন্ন আকারের শত শত জাহাজ বন্দরে নোঙর করত। কিন্তু সেইলিং বোটে থাকার ব্যবস্থা না থাকায় নাবিকরা কূলে নেমে আসত। খালি জায়গায় বিছানা পেতে থাকত তারা।

“আগ্রহের দিক থেকে এটা ছিল বেশ। কারণ এটা বিশ্বকে আমাদের কাছে নিয়ে আসত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্থায়ী অবস্থান জানজিবারে ছিল। যখন বড় সংখ্যায় বাইরের মানুষ আসার কথা বলছি, তখন বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি ও বহু রকমের খাবার আর তারা মূলত কালচে হত, তাদের সমুদ্রে কষ্টকর যাত্রার কারণে। এক ধরনের হুড়োহুড়ি আর চেঁচামেচি লেগেই থাকত।”

১৯৬৪ সালে জানজিবারে বিপ্লব শুরু হলে ১৩ বছর বয়সী শিশুমনে কী রকম প্রভাব পড়েছিল, তা স্পষ্ট মনে থাকার কথা তুলে ধরেন এ লেখক।

ছোটোবেলায় কী বই পড়তেন- এমন প্রশ্নে গুরনাহ বলেন, অতো বই পাওয়া যেত না, তবে সামনে যা পেতেন গোগ্রাসে পড়তেন তিনি।

“যদিও অতো বেশি কিছু পাওয়া যেত না, তবুও সামনে যা পাওয়া যেত আমি তাই পড়তাম। জানজিবারে বহু ধরনের বই আসার ব্যবস্থা ছিল না। বই কেনার ধারাও মানুষের মধ্যে সেভাবে ছিল না। কিছু বই পাওয়া যেত স্কুলে।”

১০ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তিন মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন থাকার স্মৃতিচারণ করে তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুনে সবগুলো পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত করে ফেলার কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।

Also Read: মঞ্চের তারকা নয়, আমার আগ্রহ সাধারণ জীবনে: গুরনাহ

Also Read: প্রকাশের, বিকাশের, বিচ্ছুরণের প্রত্যাশায় শুরু ঢাকা লিট ফেস্ট

Also Read: আড্ডা-আলাপে লিট ফেস্টের জমজমাট প্রথম দিন পার

“যখন আমি স্কুলে ফিরলাম, তখন দেখি সবগুলো পাঠ্যপুস্তকই আমার মুখস্ত। দেখা গেছে, ভূগোলের ক্লাসে শিক্ষক যখন প্রশ্ন করছিল, তার সবগুলো উত্তরই আমার জানা। কারণ আমি পুরো বই মুখস্ত করে ফেলেছিলাম।”

সংঘাত আর সামরিক শাসনের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ষাটের দশকের শেষে দেশ ছাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কথা তুলে ধরেন গুরনাহ।

ইংল্যান্ডে গিয়ে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। এক পর্যায়ে লেখেন নিজের প্রথম উপন্যাস ‘মেমোরি অব ডিপার্চার’।

নিজে স্বদেশ ছেড়ে যাওয়ার কষ্টকর অভিজ্ঞতাই কী এই উপন্যাসের উপজীব্য, সঞ্চালকের এমন প্রশ্নে তানজানিয়া বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এ লেখক বলেন, “কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর নিবদ্ধ না থেকে আমি সেই সময়টা নিয়ে লেখার চেষ্টা করছিলাম। এখানে একটা ব্যাপার ছিল, কীভাবে আমি এমন লোকদের কথা লিখব না যারা এখনও সেই ঝামেলার মধ্য আছে, তাদের রক্ষা করে।

“বঞ্চনাটা কী রকম আর নাগরিক অধিকার কেমন হওয়া উচিত এসব বিষয়ে আমি লিখতে চেয়েছিলাম। অন্যান্য অধিকার নিয়েও। এটা শুধু আমি কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছি তা নয়, তার বাইরে আমি কী অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছি এবং যেসব বিষয়ের সাক্ষী হয়েছি। যারা এ ধরনের নৃশংসতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তাদের অনেককে আমি চিনতাম।”

অন্তহীন কষ্ট পেরিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেওয়ার পর সবকিছু সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যের ছিল কি না এমন প্রশ্নে আসে অনুষ্ঠানে। জবাবে গুরনাহ বলেন, অনেক সুযোগের মধ্যেও বিরুদ্ধ পরিবেশ তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেটা হচ্ছে বর্ণবাদী আচরণের কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে রাস্তা, বিভিন্ন জায়গায় প্রতিকূল পরিবেশ থাকলেও সেটা ছিল রোমাঞ্চকর। নতুন জায়গায় আসতে পেরে স্বাধীনতাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা। স্বাধীনভাবে কথা বলা, যেটা চিন্তা করার ইচ্ছা- সেটা চিন্তা করতে পারা আর এটার জন্য আপনাকে কেউ শাস্তি দেবে না।

“লন্ডনে চমকপ্রদ ভিন্নতা ছিল প্রচুর বই পাওয়া, যা আগের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা। এখানে আপনি সব ধরনের বই পড়তে পারছেন। একের পর এক বই আপনি পাবেন। এর ফলে আমি সাহিত্য পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করি।”

লেখক হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়ে এই নোবেল বিজয়ী বলেন, প্রথম দিকে স্কুল জীবনে শুধু শিক্ষককে দেখানোর জন্য লিখতাম। সেসময় ওইগুলোকে আমি লেখা হিসাবে ভাবতাম না। এরপর নিজের বোঝাপড়ার জন্য লিখতে শুরু করি।

“এক পর্যাযে আমি চিন্তা করলাম, আমি এখন লিখতে পারি যাতে অন্যরা তা দেখতে পারে। এটা এমন ছিল না, আমার কেমন মনে হয়। এটা ছিল ভিন্ন রকম বিষয়। এমন বিষয় লেখার চেষ্টা করতাম যা পাঠকের কাছে যেতে পারে। কিন্তু বই প্রকাশের তেমন ধারণা আমার ছিল না।”

ইংল্যান্ডে এসে সাহিত্যের যে জগতে গুরনাহ বিচরণ করেছেন জানজিবারে থাকলে সেই পথে কি তিনি থাকতেন?

এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি সত্যিকার অর্থে এটা জানি না। এটা এমন একটা বিষয় যা নিয়ে আমি ভেবেছিও, এভাবে এই পথে যেতাম কি না আমার সন্দেহ হয়।

“কারণ এই পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তার অনেক কিছুই আমি জানতাম না। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি, আসলে কী আমি লিখতাম? আসলে সত্যিকার অর্থে আমি জানি না।”

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির একটি মনোরম এবং আরেকটি বাজে অভিজ্ঞতার বিষয়ে অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা হয় গুরনাহকে।

লেখা প্রাপ্তি ও বহু ভাষায় লেখার অনুবাদ বের হওয়াকে ‘ভালো’ অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “ভালো লাগার বিষয়ের একটি হচ্ছে ‘আপনার লেখা ভালো’ এমন স্বীকৃতি এবং সবগুলো লেখা আবার ছাপা হয়েছে এবং পুনরায় পাওয়া যাচ্ছে। এটা সত্যি অসাধারণ।

“নতুন সংস্করণ আর ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে। যেসব ভাষায় আমি কস্মিনকালেও আমি পড়তে পারতাম না, সেটাকে ছাপানোতো দূরে থাক।”

নোবেল প্রাপ্তির কোনটিকে খারাপ দিক বলবেন নন্দিত এই লেখক সেই প্রতীক্ষায় ছিলেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা।

“বাজে দিক…? বাজে কোনো দিক আসলে নেই,” স্বহাস্যে বলেন গুরনাহ।