শারদ বন্দনায় প্রকৃতি রক্ষার প্রত্যয়

ঋতুবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার প্রত্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় শরৎ বন্দনায় অংশ নেন সংস্কৃতিজনরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Sept 2022, 06:51 AM
Updated : 23 Sept 2022, 06:51 AM

‘ক্ষেতের আলে নদীর কূলে পুকুরের ওই পাড়টায়/হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে বাঁশ বনের ওই ধারটায়’; কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘কাশফুলের কাব্য’ আবৃত্তি, শরতের গান আর নৃত্যে উদযাপিত হল ‘শরৎ উৎসব-১৪২৯’।

ঋতুবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার প্রত্যয়ে শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শরৎ বন্দনায় অংশ নেন সংস্কৃতিজনরা।

শিশিরস্নাত সকালে প্রাণ-প্রকৃতির কথন, গান আর নৃত্য পরিবেশন করে শরৎ উৎসবে কংক্রিটের নগরী যেন মাতিয়ে তোলেন শিল্পীরা।

সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর এই আয়োজনে ‘শরৎ কথন’ পর্বে অংশ নেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।

‍তিনি বলেন, “ছয় ঋতু নিয়ে আমাদের প্রকৃতি। এগুলো নিয়ে বিভিন্নজন নানাভাবে সাহিত্য ও শিল্পকর্ম করেছেন। মূলত রবীন্দ্রনাথই ষড়ঋতুকে আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি ফুটিয়ে তুলেছেন।

“আর আমাদের দেশে শুরুতে ছায়ানট পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে ঋতু উৎসব শুরু করেছে। এক সময় ঘরে ঘরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পহেলা বৈশাখকে ছুটির দিন ঘোষণা করেছেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান উৎসবে যোগ দিয়ে বলেন, “শরতের আকাশ বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রশস্ত, সুবিশাল ও গভীর। এই প্রকৃতি থেকেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

“সেটি হল, শরতের এই সুবিশাল আকাশ যেন আমাদের মনের গভীরতা বৃদ্ধি করে, মনকে আরও প্রসারিত করে। মনের গভীরতা ও উদারতা বৃদ্ধি পেলে সেই মানুষ হবে অনেক অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক।”

বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও বৃক্ষ নিধন করে নগরায়ন, কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঋতুগুলো আগের মত নেই বলে মনে করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।

তিনি বলেন, “প্রকৃতির যে অপরূপ সৃষ্টি, সেটি আজকে আমরা হারাতে বসেছি। ক্রমাগতভাবে বৃক্ষ নিধন, শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সবকিছু মিলিয়ে আমরা ঋতুগুলোকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছি।

“সুতরাং শরৎ, হেমন্তকে বাঁচিয়ে রাখতে, সমস্ত ঋতুকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে প্রকৃতিকে আমাদের ভালোবাসতে হবে। বৃক্ষরোপণ করতে হবে, পলিথিন থেকে শুরু করে যেগুলো প্রকৃতি ধ্বংস করছে সেগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে।”

শরৎ উৎসবের সভাপতি ও সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সহ-সভাপতি ড. নিগার চৌধুরী বলেন, “নগর জীবনে যারা তার প্রকৃতির দিকে তাকানোর সুযোগ পায় না, তাদেরকে জানান দিতে আমাদের এই উৎসব যে, প্রকৃতিতে শরৎ এসেছে।

“শরতের আমেজ আমাদের মাঝে বিরাজ করুক। শরৎ হচ্ছে সমৃদ্ধির ঋতু। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বর্ষায় আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই, শরতে আমরা মাঠ ভরা ফসলের দিকে তাকাই’। এই উৎসব থেকে আমরা একটি বার্তা দিতে চাই, সেটি হল আসুন আমরা প্রকৃতির প্রতি সচেতন ও যত্নশীল হই।”

উৎসবে একক আবৃত্তি পর্বে নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি পাঠ করেন নির্মলেন্দু গুণের ‘কাঁশফুলের কাব্য’, আহসান উল্লাহ পাঠ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’ থেকে। সেবতি প্রভা পড়েন মো. নাসির ‍উদ্দিনের ‘শরৎকাল’ কবিতাটি।

একক সংগীত পর্বে ফাহিম হোসেন চৌধুরী শোনান রবীন্দ্রসংগীত ‘এবার অবগুণ্ঠন খোলো’, অনিমা রায় শোনান ‘শরৎ আলোর কোমল বনে’, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস শোনান লোকসংগীত ‘হিংসা হিন্দা ছাড়ো’।

এরপর সঞ্জয় কবিরাজ শোনান নজরুল সংগীত ‘দূর প্রবাসে মন কাঁদে’, আরিফ রহমানের কণ্ঠে লোকসংগীত ‘চাতুরি করিয়া মোরে’, ফেরদৌসী কাকলীর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘হৃদয়ে ছিলে জেগে’, রত্না সরকারের কণ্ঠে ‘আকাশটা তো নীল চিঠি নয়’ আধুনিক গানে উৎসবে মাতেন সবাই।

পরে এস এম মেজবা শোনান ‘আরে ও জীবন ছাড়িয়া না যাও মোর’, শ্রাবণী গুহ রায় শোনান আধুনিক গান ‘আমি সুরের পিয়াসী’, নবনীতা জাহিদ চৌধুরী অনন্যা শোনান ‘ভাসে আকাশে শুকতারা হাসে’, তাপসী ঘোষ শোনান কীর্তন ও সবশেষে মারুফ হোসেন শোনান ‘মনে নাইগো আমার বন্ধুয়ার মনে নাই’ শিরোনামে রাধারমণের গান।

দলীয় সংগীত পর্বে বহ্নিশিখা পরিবেশন করেন আগমনী সংগীত ‘শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী’, সুরনন্দনের শিল্পীরা শোনান ‘এসো শারদ প্রাতের প্রতীক’, পঞ্চভাস্করে শিল্পীরা শোনান ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়’, সুরবিহারের শিল্পীরা গেয়েছেন ‘শিউলি তলায় ভোরবেলায়’, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা শোনান ‘দেখ দেখ শুকতারা আঁখি মেলে চায়’ ও ‘নম নম নম বাংলাদেশ মম’।

রবীন্দ্রসংগীত ‘ওগো শেফালী ওগো শেফালী’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্য সংগঠন ভাবনার শিল্পীরা। ‘আজ শরতে আলোর বাঁশি বাজলো’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনায় ছিল নৃত্যাক্ষ।

রবীন্দ্রসংগীত ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী’ গানের সঙ্গে মঞ্চে আসে নৃত্য সংগঠন নৃত্যজনের শিল্পীরা; বাফার শিল্পীরা নজরুল সংগীত ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। এ ছাড়া নৃত্য সংগঠন স্পন্দন আগমনী নৃত্য পরিবেশন করে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।