ট্রাক চালক হেলালসহ মোট আটজন এখন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি; সাভারে তেলের ট্যাংকারের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন তারা।
Published : 02 Apr 2024, 11:50 PM
কৈশোরেই ট্রাক চালক হেলাল হাওলাদারের সঙ্গে বিয়ে হয় সোনিয়া আক্তারের। তরুণ চালক হেলাল যখন ট্রাক নিয়ে এ জেলায় ও জেলায় যেতেন, কিছুক্ষণ পরপরই স্ত্রী ফোন করে খোঁজ নিতেন। সোনিয়ার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর সম্প্রতি তাদের সংসারে নতুন সুখের বার্তা নিয়ে এসেছিল।
সোমবার বরগুনা থেকে ট্রাকে তরমুজ বোঝাই করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় হেলাল। মঙ্গলবার ভোরে পরিবার খবর পায়, আগুনে পুড়ে হেলাল ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি।
সেই খবরে বরগুনা থেকে সোনিয়াসহ স্বজনেরা ছুটে এসেছেন ঢাকায়। চিকিৎসকরা বলছেন, হেলালের শরীরের শতভাগ পুড়েছে, পুড়ে গেছে শ্বাসনালীও। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।
হাসপাতালে পৌঁছে হেলালকে একবার দেখে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী সোনিয়া। একটাই কথা তার, তাদের সন্তান যেন বাবার মুখটা দেখতে পায়।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের ষষ্ঠ তলায় হাই ডিপেন্ডেন্সি (এইচডিইউ) ইউনিটের সামনে কথা হয় সোনিয়া এবং তার স্বজনদের সঙ্গে। তারা কাঁদছিলেন, প্রার্থনা করছিলেন, যেন হেলাল সুস্থ হয়ে ওঠেন।
একই ঘটনায় দগ্ধ আরো সাতজন ভর্তি আছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে, তাদের পরিবারের সদস্যরাও ষষ্ঠ তলায় জড়ো হয়েছিলেন একই প্রার্থনা নিয়ে।
পুলিশ বলছে, তেলবাহী একটি ট্যাংকার গাবতলী থেকে সাভারে যাওয়ার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোড়পুল এলাকার কাছে ইউ টার্ন নিতে গিয়ে উল্টে যায়। তাতে ট্যাংকারের তেল ছড়িয়ে আগুন ধরে যায়।
সেই আগুনে পুড়ে যায় আরো দুটি ট্রাক ও একটি সেডান। আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়। নজরুল ইসলাম নামে এক তরমুজ বেপারি মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার পথে।
ওই আগুনে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন বরিশালের বাকেরগঞ্জের মিলন (২২), বরগুনার আল আমিন (৩৫), মিম (১০), নিরঞ্জন (৪৫), ট্রাক চালক হেলাল (২১), হেলপার সাকিব (১৬) ও রাজশাহীর আবদুস সালাম (৩৫) ও আরেক ট্রাকের চালক মো. আল আমিন (২২)।
ওই তরমুজের ট্রাকে ছিলেন চালক হেলাল, হেলপার সাকিব, তরমুজের বেপারি নজরুল ইসলাম, নিরঞ্জন, আল আমিন এবং তার ১০ বছরের মেয়ে মিম।
দগ্ধদের মধ্যে হেলাল, সাকিব ও নজরুল ইসলামকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন আলী হাসান নামে এক পোশাক কর্মী। দুপুরেও বার্ন ইনস্টিটিউটে পোড়া রোগীদের স্বজনদের সঙ্গে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় তাকে।
আলী হাসান বলছেন, চন্দ্রায় কারখানায় যাওয়ার জন্য ভোর ৬টায় জোরপুল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তিনি দেখেন গাড়িতে আগুন লেগেছে। তিনজন লোক রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কাতরাচ্ছেন।
তখন তিনি ৯৯৯ এ ফোন করে একটি অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে এলে তিনি তিনজনকে নিয়ে প্রথমে সাভার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। সেখানে ভর্তি না নিলে তাদের নিয়ে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের দিকে রওনা হন।
দগ্ধদের মধ্যে তরমুজের বেপারি নজরুল কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন। স্ত্রীর নম্বর দিয়ে ফোনও করতে বলেন।
আলী হাসান বলেন, “আমি নজরুলের স্ত্রীকে ফোন করে ঘটনা জানানোর কিছুক্ষণ পর গাড়ি যখন কল্যাণপুরে, তখন ছটফট করতে করতে নজরুল মারা গেলেন।”
বাকি দুজন ট্রাক চালক হেলাল ও হেলপার সাকিবও তাদের পরিবারকে জানাতে বলে, ফোন নম্বর দেয়। তাদেরকেও দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে দেন আলী হাসান।
হেলপার সাকিবের বড় ভাই নাঈম এসেছেন হাসপাতালে। তিনি বলছেন, অভাবের কারণে তাদের দুই ভাইয়ের কারো পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। তিনি ভবন নির্মাণের জন্য পাইলিং শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।
তাদের বাবা খাগড়াছড়িতে অটোরিকশা চালান। আর ছোট ভাই সাকিব স্কুল ছেড়ে কয়েকমাস হয় ট্রাকে উঠেছে হেলপার হিসেবে। তাদের মা বরগুনাতেই থাকেন। সাকিব ডিউটি না থাকলে মায়ের সঙ্গেই থাকতেন।
নাঈম পাইলিংয়ের কাজ করছিলেন বাগেরহাটের মোংলায়। ভোরবেলায় সাকিবের দগ্ধ হওয়ার খবর শুনে ছুটে এসেছেন ঢাকায়।
চিকিৎসকরা বলছেন, সাকিবের শরীর শতভাগ পুড়ে গেছে। এই খবর জানার পর থেকে নাঈম কেঁদেই চলেছেন।
বার্ন ইনিস্টিউটের সহকারী পরিচালক হোসাইন ইমাম বলছেন, চালক হেলালের মত হেলপার সাকিবের জীবনও সংকটাপন্ন।
ওই ট্রাকেই ছিলেন তরমুজ ব্যবসায়ী আল আমিন ও তার ১০ বছরের মেয়ে মিম। বাবা-মেয়ে দুজনেই পুড়েছেন। মিমের শ্বাসনালীও পুড়েছে।
খবর শুনে হাসপাতালে এসেছেন আল আমিনের বাবা শহীদ তালুকদার। তিনি বলছেন, বরগুনা থেকে আল আমিন তরমুজ নিয়ে ঢাকায় যাবে শুনেই মিম জের করতে থাকে বাবার সঙ্গে আসার জন্য। মেয়ের জেদে পরাস্ত হয়ে বাবা তাকে ট্রাকে তুলে নেন। ইচ্ছে ছিল সাভারে মামাবাড়িতে নামিয়ে দেবেন মিমকে। কিন্তু তার আগেই ট্রাকে আগুন লেগে যায়।
শহীদ তালুকদার বলেন, এই মৌসুমে তরমুজ চাষ ও তরমুজ কিনতে ঋণ করে টাকা লগ্নি করেছিলেন আল আমিন। এখন যমে-মানুষে টানাটানির মধ্যেও তার ঋণের চিন্তা মাথা থেকে যায়নি।
ওই ঘটনায় পুড়ে গেছে প্রিমিয়ার সিমেন্ট বাহী একটি ট্রাক। ট্রাকের চালক দগ্ধ আল আমিন (২২) জানান, তারা মুন্সীগঞ্জ থেকে সাভারে যাচ্ছিলেন। আগুন দেখে তিনি লাফিয়ে বের হয়েছেন। কিন্তু তার হেলপার ইকবাল সেখানেই পুড়ে মারা গেছে।
দগ্ধ হয়েছেন শ্রমিক মিলন মোল্লাও। তার ভাষ্য, ঘটনাস্থলে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ হিসেবে যে লাশটি রয়েছে সেটি হেলপার ইকবালের।
একই আগুনে পুড়েছেন একেএইচ গ্রুপের গাড়ি চালক আব্দুস সালাম। তিনি জানান, গাড়িতে তেল নিয়ে বের হতেই তিনি আগুনের কবলে পড়েন। তার শরীরের ৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে দগ্ধ এসব রোগীদের দেখে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, “দগ্ধদের কেউ শঙ্কামুক্ত নয়। আর এই সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা একটা কথা সবসময় বলি, বাড়ি ফেরা না পর্যন্ত এসব রোগীকে শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না।”