ফ্ল্যাটে খাবারবিহীন দিন কাটছিল অসুস্থ মা-মেয়েদের, খোঁজ রাখেনি কেউ

১৫ দিন বাসায় বাজার হয়নি। ছিল না বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন। ফ্ল্যাট থেকে প্রায়ই শিশুদের চিৎকার আর কান্নার শব্দ পাওয়া যেত বলে নিরাপত্তা কর্মী জানিয়েছেন।

গোলাম মর্তুজা অন্তুজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2023, 01:39 PM
Updated : 7 Feb 2023, 01:39 PM

রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে যে অসুস্থ নারী ও তার দুই যমজ মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল দুই দিন আগে, সপ্তাহখানেক ধরে তারা না খেয়ে থাকলেও কেউ তাদের খোঁজ রাখেনি।

১৫ দিন বাসায় বাজার হয়নি। ছিল না বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও। ফ্ল্যাট থেকে প্রায়ই শিশুদের চিৎকার আর কান্নার শব্দ পাওয়া যেত। তাদের ঘরে খাবার, পোশাক কিছুই ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ।

রোববার ভোরে ওই ভবনের দোতলার ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে সেই নারী আর তার ১০ বছর বয়সী যমজ মেয়েকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার তাদের পাঠানো হয় শেরেবাংলা নগরে মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে।

পুলিশ বলছে, মধ্য ত্রিশের শাফানা আফিফা শ্যামীর বাবা ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। পৈত্রিক সূত্রে ফ্ল্যাটটি পান তিনি। শ্যামী সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন বলে স্বজনেরা পুলিশকে জানিয়েছেন।

শুরু থেকেই দুই শিশু ও তার মায়ের খোঁজ-খবর রাখছেন পুলিশের উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, ওই শিশুদের কোনো পোশাক বাসায় পাওয়া যায়নি। তাদের মায়েরও তেমন কোনো পোশাক বাসায় ছিল না। বিষয়টি উত্তরায় একটি খেলাধুলার সংগঠনের সদস্যদের জানানোর পর এক ব্যক্তি উৎসাহী হয়ে ওই নারী ও তার মেয়েদের জন্য পোশাকসহ জরুরি সবকিছু কিনে দেন।

মুজাহিদুল বলেন, “উনি ওই বাচ্চাদের জন্য শীতের কাপড়সহ ডাবল ডাবল জামা কিনে দিয়েছেন। তাদের মায়ের জন্যও পোশাক পাঠিয়েছেন। পাশাপাশি পেস্ট-ব্রাশ থেকে যা যা লাগে। মেয়র স্যার, এমপি স্যারসহ অনেকেই বলে রেখেছেন, তারাও সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু আসছেন না ওদের আপনজনেরা।”

পুলিশ জানাচ্ছে, শ্যামীর বাবার দুই স্ত্রীর সংসার মিলিয়ে ছয় সন্তান। এর মধ্যে শ্যামীরা চার ভাই ও এক বোন। ভাইবোনদের মধ্যে শ্যামী তৃতীয়। তার চার ভাইই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এক ভাই কানাডা প্রবাসী। এক ভাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। কিন্তু গত দুই দিনে তারা কেউ দেখতে আসেননি।

শ্যামীর মাও আছেন, তবে অসুস্থ। শ্যামীর মা ও ভাইয়েরা আগে উত্তরার ওই বাড়িতেই ছিলেন। গত অগাস্টে তারা বনানীতে আরেক বাসায় উঠেছেন।

শ্যামীর চাচাতো বোন জহুরা রতন রূপা ও তার কলেজ শিক্ষক স্বামী সোমবার হাসপাতালে এসে খোঁজখবর নিয়ে যান। রূপা বলছেন, তিনি বৃহস্পতিবার উত্তরায় শ্যামীর বাসায় গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। অনেকক্ষণ ধাক্কানোর পরও ভেতর থেকে খোলেননি শ্যামী। মোবাইল ও ইন্টারকমেও সাড়া দেননি।

স্বজনরা জানান, ২০০৪ সালে উত্তরার ওই বাড়িটি করেন রূপার বাবা। এই ভবনে তাদের চারটি ফ্ল্যাট ছিল। শ্যামীর বাবা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে পারিবারিক ঝামেলা শুরু হয়।

রূপা জানান, ২০১২ সালে শ্যামী উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একজন ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শ্যামী অন্ত্বঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর থেকেই শ্যামী মানসিকভাবে আর সুস্থ ছিলেন না। বাবা-ভাইয়েরাই তাকে দেখতেন। মাঝে শ্যামীর স্ট্রোক হয়েছিল। তিনি কিছুদিন ভালো থাকেন, কখনো আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার আয়ের নিয়মিত উৎস বলতে ছিল গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে পাওয়া চার হাজার টাকা। প্রবাসী ভাইও তাকে টাকা পাঠাতেন, কিন্তু শ্যামী তা নিতে চাইতেন না।

হাসপাতালে শিশু দুটি ও তার মায়ের দেখভাল করছে বেসরকারি সংস্থা পারি ফাউন্ডেশনের কয়েকজন স্বেচ্ছাকর্মী। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা পারি ফাউন্ডেশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক ওয়াসিম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের তিনজনকে একটি আলাদা কেবিনে রাখা হয়েছে। 

কেবিনের দরজায় একজন আনসার সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে। শ্যামী ভালো আছেন। তবে তার দুই মেয়েই মানসিকভাবে অনেক অসুস্থ। তারা সারাক্ষণ বিড়বিড় করছে। বাংলা কথা বুঝলেও তারা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না।

ওয়াসিম খান বলেন, “ওই বাচ্চাদুটোকে দেখে আমারই কান্না চলে আসছে। গায়ে-জামা কাপড় ছিল না। চুলগুলো সব জট পাকিয়ে রয়েছে, মাথা ভরা উকুন। আমরা ওদের চুল কামিয়ে দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছি।” 

থালাভর্তি খাবার দেখেও শিশুদুটি অস্বাভাবিকরকম আনন্দিত হয়েছে জানিয়ে ওয়াসিম খান বলেন, “তাদের জন্য দুপুরের খাবার আনার পর সেটা দেখে একটা বাচ্চা ‘আমি খাবো আমি খাবো, মুরগির মাংস দিয়ে খাব’ বলে প্রথমে আনন্দে নাচতে থাকে। পরে সে এসে প্লেট কেড়ে নিয়ে যায়। খাবলে খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে যাওয়ার দশা হয়। এরা মনে হয় অনেকদিন না খাওয়া।” 

Also Read: দুই সন্তানকে নিয়ে ঘরবন্দি মা, মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার

একটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বেশি খারাপ জানিয়ে ওয়াসিম বলেন, “সে সবকিছুতেই ভয় পাচ্ছে। ওকে বাথরুমেও নেওয়া যাচ্ছে না। আবার বেশিক্ষণ কাছে থাকলে জড়িয়ে ধরছে, কোলে উঠতে চাইছে। ওদের মা বেশি মানুষ পছন্দ করছেন না, একা থাকতে চাইছেন। স্বজনদের কথা জানতে চাইলে বলছেন, ‘আমার কেউ নাই, কিছু নাই। আমি রাস্তার মানুষ’।” 

ওয়াসিম গিয়েছিলেন উত্তরার ওই বাড়িতে। ঘুরে এসে তিনি বলছেন, বাড়িতে তীব্র দুর্গন্ধ। রান্নাঘরের সিংক উপচে পড়ছে পানি, সেই পানিতে শ্যাওলা ভাসছে। বাসায় দুটো বেডরুমের একটিতে সিটকিনি আটকে ছিলেন শ্যামী। সেই ঘরে দুটো খাট। একটি খাটে জাজিমের ওপর খালি একটা ওয়ালক্লথ বিছানো। সবকিছুই খুবই নোংরা, দুর্গন্ধময়।

বাসার রান্নাঘরে হলুদ-মরিচ, চাল-ডাল কোনো কিছুই ছিল না, ছিল শুধু লবণ। সবগুলো হাড়ি-পাতিল ছিল খালি। তবে খাবার পানির বোতলে পানি ছিল। বাসায় একটি ঘরে এসি আছে। তবে কোন টিভি-ফ্রিজ নেই। বাসায় বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ দেখেননি ওয়াসিম। না খেতে খেতে ওরা শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল বলে তার ধারণা। 

মা ও তার দুই মেয়ের স্বাস্থ্য ও মানসিক পরিস্থিতি নিয়ে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের চিকিৎসকরা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।

হাসপাতালের তথ্য কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা কয়েকদিন ধরে অনাহারে ছিলেন। এজন্য হাসপাতালে আনার পর তাদের স্যালাইন দিয়ে দুর্বলতা কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া তাদের আর তেমন কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। তাদের মানসিক সমস্যা রয়েছে। সেজন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়।”

মঙ্গলবার সকালে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ইশতিয়াক বলেন, “উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশের পরিদর্শক মুজাহিদুল ইসলাম আজ তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের উদ্দেশ্যে গাড়িতে তুলে দিয়েছেন।”

উত্তরার ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন আব্দুর রহমান। তিনি বলছেন, ওই বাসার বাচ্চারা মাঝে মধ্যেই চীৎকার ও কান্নাকাটি করত। বাইরে থেকে শব্দ পাওয়া যেত। মাঝে মধ্যে ওপরে চেয়ার-টেবিল ফেলে দেওয়ার মত ধুপধাপ শব্দ হত। 

রহমান বলছেন, গত ১৫ দিন ধরে তিনি শ্যামীর ফ্ল্যাটে কোনো বাজার ঢুকতে দেখেননি। আগে একটি ছেলে এসে বাজার করে দিত, বেশ কিছুদিন ধরে সে আসছে না। গত বুধবার বিদ্যুতের লোক আসছিল। পরে ইন্টারকমে কথা বলিয়ে দেন আব্দুর রহমান। বিদ্যুতের লোকেরা লাইন কেটে দিতে চাইলে শ্যামী তাদের তা করতে বলেন। পরে তারা লাইন কেটে দিয়ে চলে যায়।

ভবনে এত লোকজন থাকতেও কেউ তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেনি কেন জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, “তার মা আছে, ভাই আছে। তারা জায়গার মালিক, তারা কিছু না করলে আমরা কী করব।” 

তিনি জানান, গত অগাস্টেই শ্যামীর মা ও ভাইয়েরা এই ভবনের ফ্ল্যাট ছেড়ে বনানীতে গিয়ে ওঠেন। তাদের সঙ্গে তখনো শ্যামীর সুসম্পর্ক ছিল না। আর ভবনের লোকেরাও শ্যামীর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি ভবনের সার্ভিস চার্জ দিতেন না। 

শ্যামী না খেয়ে দিন পার করলেও তার ফ্ল্যাটের দামই দেড়-দুই কোটি টাকা হবে বলে ধারণা নিরাপত্তাকর্মী আব্দুর রহমানের। প্রতিটি ফ্ল্যাটে দুটো বেড, ড্রয়িং-ডাইনিং ও ব্যালকনি রয়েছে। স্থানীয়রা জানালেন, এক হাজার বর্গফুটের কিছু বড় আকারের এরকম ফ্ল্যাট এখন এক থেকে দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে তাদের এলাকায়। 

এনজিও কর্মী ওয়াসিমের ভাষ্য, “এমন প্রতিষ্ঠিত একটা পরিবারের মেয়ের এরকম জীবন হতে পারে তা কল্পনাতীত। স্বজনেরা একটু যত্ন নিলেই আশা করা যায় তারা সুস্থ হয়ে ফিরবে।”