ঘনঘন অগ্নিকাণ্ড: ঢাকায় ফায়ার হাইড্রেন্ট বসবে কবে?

“রাস্তার পাশে হাইড্রেন্ট বসাতে মাস্টারপ্ল্যান লাগে, সেটা এই শহরে নাই। আর আমাদের দেশের রাস্তায় গাড়িই তো ঢোকে না, হাইড্রেন্ট বসানোর জায়গা কোথায়,” বললেন ওয়াসার এমডি।

ওবায়দুর মাসুমজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2023, 06:50 PM
Updated : 19 April 2023, 06:50 PM

এপ্রিলের শুরুতে ঢাকার বঙ্গবাজারে যখন আগুন লাগল, ঠিক পাশেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর থেকে অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর প্রথম দলটি সেখানে পৌঁছে যায় দুই মিনিটের মধ্যে। কিন্তু ফায়ার ব্রিগেডের একটি গাড়ি যে পরিমাণ পানি বহন করে, তা মোটামুটি ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আর বঙ্গবাজারের আগুন ততক্ষণে নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে। 

সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের সময় লাগে সাড়ে ছয় ঘণ্টা। আর পুরোপুরি নেভাতে ৭৫ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ততক্ষণে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট, আদর্শ ইউনিট, মহানগর কমপ্লেক্স সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় এনেক্সকো টাওয়ার, ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেট।

ঈদের আগে অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনায় সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকান পুড়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটি হিসাব দিয়েছে। আর সোয়া কোটি মানুষের শহর ঢাকায় ফায়ার হাইড্রেন্টের অভাবের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।

৪ এপ্রিল ভয়াবহ ওই আগুন নেভাতে আশপাশে পর্যাপ্ত পানির উৎস না থাকার কথা জানিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। পৌনে দুই একর জমির ওপর জ্বলতে থাকা কাঠ ও টিনের তৈরি হাজারো দোকানের আগুন নেভাতে যত পানি দরকার, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি তা যোগান দিতে পারছিল না।

পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পুকুরে পাম্প বসিয়ে পানির ব্যবস্থা করে দমকল বাহিনী। বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারকে দেখা যায় হাতিরঝিল থেকে পানি নিয়ে বঙ্গবাজারে ছিটাতে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেদিন আমরা পানির জন্য দৌঁড়াদৌড়ি করছি। ওই সময় ফায়ার হাইড্রেন্টের অভাব কঠিনভাবে উপলব্ধি করেছি।

“হাইড্রেন্ট থাকলে শুধু হোস পাইপ লাগিয়ে দিলেই পানি পাওয়া যেত। অথচ আমাদের পাগলের মত আশপাশে জলাধার খুঁজতে হয়েছে। আমাদের জানা ছিল পাশে পুকুর (ফজলুল হক হলের পুকুর) ওই একটাই। সেখানে ১৪টা পাম্প বসিয়েছি।”

এর ১১ দিনের মাথায় ১৫ এপ্রিল ভোরে আগুন লাগে ঢাকা নিউ মার্কেটের পাশে নিউ সুপার মার্কেটে। সেদিনও ঢাকা কলেজের পুকুরে পাম্প বসিয়ে পানি নিতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।

তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে এত দূর যেতে হয় না। এভাবে বিভিন্ন পুকুর থেকে পানি নিয়ে আসা কষ্টসাধ্য বিষয়। আর অনেক দূর থেকে পাম্প, পাইপ নিয়ে রেডি করে পানি নিয়ে আসতে দেরি হয়ে যায়। যাদের সম্পদ পুড়ে যাচ্ছে তারা তো পাগল হয়ে যায় যে পানি কেন পাচ্ছি না। কেন চারদিক থেকে পানি চলে আসছে না। তাদের বিষয়টা এমন যে ওই সময় ম্যাজিকের মত পানি চলে আসুক।”

১৩ এপ্রিল নবাবপুর রোডের একটি গুদামে আগুন লাগলে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস, ১৭ এপ্রিল উত্তরার বিজিবি মার্কেটে আগুন লাগে, সেদিনই আগারগাঁওয়ের বিএনপি বস্তি এলাকায় একটি তুলার গুদাম আগুনে পোড়ে। ১৮ এপ্রিল ওয়ারীর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটি ভবনের দোতলায় আগুন লাগে।

প্রায় প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুন নেভানোর জন্য পানির সঙ্কটে ভোগেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা বলছেন, একটি আদর্শ শহরে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থায় পানির অন্যান্য উৎসের সঙ্গে ফায়ার হাইড্রেন্ট বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু ঢাকায় সে ব্যবস্থা নেই।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোথাও আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির পানি মোটামুটি ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। সেই গাড়ি আবার পানি ভরে ফেরত আসতে সময় লাগে। বিভিন্ন বাড়ি, কলকারখানা বা জলাধার থেকে পানি আনতে সময়ক্ষেপণ হয়। এ সময় আগুন আরও বড় হয়ে যায়, যা পরে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেজন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট জরুরি।

“এটা আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। হাইড্রেন্ট ছাড়া ফায়ার ফাইটিং বিদেশিরা চিন্তাই করতে পারে না। পৃথিবীর সব জায়গায় ফায়ার হাইড্রেন্ট হল আধুনিক অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার একটা অংশ। কারণ সব জায়গায় জলাধার থাকবে না। আবার পানি থাকলেও অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হয়। এই অতিরিক্ত পানির প্রবাহটা আসে ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে।”

ফায়ার হাইড্রেন্ট যে জরুরি, সেই আলোচনা চলছে বহু বছর ধরে। প্রায় প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর নতুন করে উচ্চারিত হয়– ঢাকায় ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই কেন? 

আলী আহমেদ খান বলেন, “ফায়ার সার্ভিস থেকে বিভিন্ন সময় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন আবাসন কোম্পানিকে নতুন প্রকল্প করার সময় রাস্তার পাশের ফায়ার হাইড্রেন্ট রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।”

ফায়ার হাইড্রেন্ট কী

সহজ করে বলতে গেলে ফায়ার হাইড্রেন্ট হল বিশেষায়িত পানির কল, যা রাস্তার ধারে থাকে এবং ভাল্ব খুলে দিলে উচ্চ চাপে পানি বেরিয়ে আসে। শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থাকে ফায়ার হাইড্রেন্ট। ফলে কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সেখানে হোস পাইপ লাগিয়ে দ্রুত পানি নিতে পারেন।  

ফায়ার হাইড্রেন্ট কে বসাবে?

আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব বড় শহরেই নিরাপত্তার জন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট রয়েছে। এমনকি পাশের দেশের কলকাতায় সেই ব্রিটিশ আমলেই ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো হয়েছিল।

অনেক আলোচনার পর চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। জনবসতি, বিপণি কেন্দ্রসহ গুরুত্ব বিবেচনায় শহরের ১৭৩টি স্থানে এসব হাইড্রেন্ট বসাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।

চট্টগ্রাম শুরু করতে পারলেও ঢাকায় এখনও ফায়ার হাইড্রেন্ট আটকে আছে আলোচনার মধ্যে। এ শহরে হাইড্রেন্ট কবে বসবে, কোন সংস্থা বসাবে– তা নিয়ে আছে টানাপড়েন।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওয়াসার ৯৫০টি পাম্পের প্রতিটিতে একটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট আছে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের সময় ওয়াসা ১৮০ গাড়ি পানি সরবরাহ করেছে।

“কিন্তু রাস্তার পাশে হাইড্রেন্ট বসাতে মাস্টারপ্ল্যান লাগে, সেটা এই শহরে নাই। আর আমাদের দেশের রাস্তায় গাড়িই তো ঢোকে না, হাইড্রেন্ট বসানোর জায়গা কোথায়? রাস্তা যখন বানায় তখনই এটা করে দিতে হয়। আমাদের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস আলোচনা করছে, আমাদের দিক থেকে যা সাপোর্ট লাগবে তা করব।”

তবে ওয়াসার এমডির সাথে পুরোপরি একমত নন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপির) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফায়ার হাইড্রেন্ট বসাতে যে অনেক প্রশস্ত সড়ক প্রয়োজন, তা না। ঢাকায় সব সড়কেই পানির সরবরাহ লাইন আছে, সেখানে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো একটু জটিল হলেও অসম্ভব কিছু না।

“পরিকল্পিত শহরে একটি নির্দিষ্ট সারি ধরে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো হয়। ঢাকা অপরিকল্পিত শহর, এজন্য এখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বসাতে হবে। পুরো ঢাকা শহরে একসঙ্গে বসানো যাবে না।”

তার পরামর্শ, যেখানে কারখানা, রাসায়নিক গুদাম, মার্কেট বা জনসমাগম বেশি হয় সেসব জায়গায় আগে হাইড্রেন্ট বসাতে হবে। পুরান ঢাকায় অগ্নিঝুঁকি বেশি, সেজন্য সেখানে ফায়ার হাইড্রেন্টের চাহিদাও বেশি থাকবে। এতে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।

“কিছু এলাকায় নেটওয়ার্ক ভিত্তিতে বসাতে হবে, যাতে একটার সঙ্গে আরেকটা সংযুক্ত থাকবে। এছাড়া প্রতিটি ভবন ধরে, শিল্প কারখানা ধরে আলাদা ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো যেতে পারে। পুরো কাজটা সরকার করতে পারবে বিষয়টা এমন না, কিছু জায়গায় ভবন মালিকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়। অন্তত মোটামুটি একটা অবকাঠামো তৈরি করে পরবর্তীতে সেটাকে সম্প্রসারণ করা যায়।”

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের সাবেক পরিচালক) উজ্জল মল্লিক জানান, পূর্বাচলে সড়কের পাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে রাজউকের। সেজন্য সড়কের পাশে জায়গাও রাখা হয়েছে। তবে তা এখনই হচ্ছে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সেখানে পানি সরবরাহ সিস্টেমের সঙ্গে ইনবিল্ট হাইড্রেন্ট হবে। এ বিষয়টা এখানে করার সুযোগ আছে। সেজন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট এখনও স্থাপন করা হয়নি। ফায়ার ব্রিগেড সেখানে একটা প্রকল্প করবে। রাজউক সড়কের জায়গা রেখেছে। এটা নতুন একটা প্রকল্প হবে। প্রভিশন আছে কিন্তু এই মুহূর্তে করা হচ্ছে না।”

২০২১ সালের জুনে মহাখালীর সাততলা বস্তি আগুনে পুড়ে গেলে সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে গিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

৮ জুন ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “বস্তিগুলোতে আমি ফায়ার হাইড্রেন্ট করে দেব। এজন্য আমি একটা বাজেট রেখেছি। আমরা প্রত্যেকটি বস্তির বিভিন্ন অংশে রাস্তায় এটা বসিয়ে দেব।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বুধবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইতোমধ্যে সাত তলা বস্তিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো প্রায় শেষ পর্যায়ে, এটা যে কোনো সময়ে খুলে দেওয়া হবে। হাইড্রেন্ট বসালে পানির ব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে ঢাকা ওয়াসাকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

“ফায়ার হাইড্রেন্ট করতে হলে সাপ্লাই ওয়াসা থেকে নিতে হবে। আর সেখানে পানির প্রেসারও থাকতে হবে বেশি। পানি টানার জন্য সেখানে পাম্প বসাতে হবে।”

মেয়রও বললেন, রাজধানীর বিভিন্ন জলাধার ভরাট করে ফেলায় পানির উৎস কমে যাচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন জলাধার ভরাট করছে। এ অবস্থায় ফায়ার হাইড্রেন্ট ছাড়া আগুন নেভানো কঠিন।

“ফায়ার হাইড্রেন্ট করতে হলে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে করতে হবে। আমরা এই শহরে বাস করি, কখন কোথায় আগুন লাগবে কেউ তা বলতে পারি না। এদিকে অবশ্যই আমাদের নজর দিতে হবে। আগুন নেভাবে ফায়ার হাইড্রেন্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি সম্মিলিতভাবে এটা করতে হবে।”