বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে কোন প্রক্রিয়ায় ফেরত পাঠানো যায়, সে পথ খুঁজতে হাই কমিশনারকে অনুরোধ করা হয়েছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।
Published : 29 Jan 2024, 08:52 PM
বাংলাদেশে ভিন্নমত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ঢাকায় কানাডার হাই কমিশনার লিলি নিকোলস।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সোমবার তার কার্যালয়ে বৈঠকের সাংবাদিকদের এক কথা জানান কানাডার দূত।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনি এ বি এম এইচ নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বৈঠকে অনুরোধ জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বৈঠক শেষে হাই কমিশনার লিলি নিকোলস বলেন, “ভালো বন্ধু হিসেবে আমরা খুব খোলামেলাভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজের গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমরা আলোচনা করেছি, ভিন্নমত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বের বিষয়েও।”
গত ৭ জানুয়ারির ভোটে ২২৩টি আসনে জিতে টানা চতুর্থবারের মত সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের একাংশ সন্তোষ প্রকাশ করলেও ভোট ‘সুষ্ঠু হয়নি’ বলে বিবৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
নির্বাচনের প্রশংসাকারী পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কানাডার দুইজন সংসদ সদস্যও ছিলেন; তাদের ওই বক্তব্যকে ব্যক্তিগত হিসেবে অভিহিত একটি বিবৃতি দিয়েছিল ঢাকায় কানাডীয় হাই কমিশন।
এরপর ভোটের পরিবেশ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার যে নীতির উপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তার ঘাটতি ছিল। এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রায়, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান ও মৌলিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সব দলের সঙ্গে স্বচ্ছভাবে কাজ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে কানাডা সরকার।”
বিবৃতিতেও আরও বলা হয়, “শক্তিশালী ও সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য কার্যকর বিরোধী দল, স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপস্থিতিতে হওয়া অবাধ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এসেও মতপ্রকাশ ও ভিন্নমতের সুযোগের বিষয় তুলে ধরেন হাই কমিশনার নিকোলস।
বৈঠকে বাণিজ্য, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের মতো দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সহায়তার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ভিন্নমতের গুরুত্বের বিষয়ে হাই কমিশনারের বক্তব্যের বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “আমরা আলোচনা করেছি যে, আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চাই, এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
“আপনি মানবাধিকারের বিষয় বলেছেন। আমি বলেছি, মানবাধিকার বৈশ্বিক ইস্যু। এটা আমেরিকারও বিষয়, ইউরোপেরও বিষয়। আমি বলেছি, এটা কানাডার ইস্যু সেভাবে নয়। তিনি বলেছেন, এটা কানাডারও ইস্যু। সুতরাং আমরা এ নিয়ে এনগেজমেন্টের মধ্যে আছি, সে নিয়ে বলেছি। এবং আমরা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের মতামতকে গুরুত্ব দিই।”
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কোনো উদ্বেগ জানিয়েছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “না, না। এই রকম কোনো আলোচনা হয়নি। তারা বলেছে, তারা আমাদের সাথে এনগেজমেন্ট বাড়াতে চায়।”
নির্বাচন নিয়ে কানাডার হতাশা প্রকাশের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বরং নতুন সরকারের সাথে এনগেজমেন্ট বাড়ানোর জন্যইতো কানাডার হাই কমিশনার আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন।”
নূর চৌধুরীকে ফেরত চান হাছান
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর চৌধুরীকে ফেরানোর অনুরোধ জানানোর কথা তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে। তাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করেছি।”
দুই দফায় ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকি পাঁচ খুনি এখনও অধরা। তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী।
এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ বারবার দাবি জানালেও তাদের ফেরত পাঠানো হয়নি।
বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পায়নি সরকার। মোসলেম উদ্দিন ভারতে আছেন বলে গত বছর পত্রিকায় খবর এলেও তার ‘সত্যতা নিশ্চিত’ হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।
গত অগাস্টে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কানাডায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার খলিলুর রহমান বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এরপর খুনি তাদের উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন এবং এখানে অন্যান্য আইনি জটিলতাও রয়েছে।
“কানাডা সরকার এমন সিদ্ধান্তে আসে যে, তাকে এমন দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে। কারণ, কানাডার অধিকার ও স্বাধীনতা সনদ সাধারণত এই ধরনের বিষয়ে অনুমোদন দেয় না।”
তবে ওই সনদের ভেতরেই এই জঘন্য খুনিকে ফেরত পাঠানোর সুযোগ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এক সময় তাকে কানাডার ইমিগ্রেশন বোর্ড মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। এ ধরনের জঘন্য অপরাধীকে যেখানে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে এমন দেশে প্রত্যাবাসন করা যায়।
“সেই বিবেচনায়, কানাডার অধিকার ও স্বাধীনতা সনদ লঙ্ঘন না করেই এই খুনিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যায় এবং ফেরত পাঠানো উচিত।”
কানাডীয় আইনে খুনিকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রীর ’বিশেষ ক্ষমতা’ থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তবে এই বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োগ অত সহজ বিষয় নয়।”
মৃত্যুদণ্ড আছে এমন দেশে সাজাপ্রাপ্তকে পাঠানোর ‘অসুবিধার’ কথা কানাডা বললেও কোন প্রক্রিয়ায় নূর চৌধুরীকে পাঠানো যায়, সে পথ অনুসন্ধানের অনুরোধ সোমবার হাই কমিশনারকে করা হয়েছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।
হাছান মাহমুদ বলেন, “তাদের যে অসুবিধা, মৃত্যুদণ্ড সেদেশে নাই বিধায়, এটাকে বাধা হিসাবে তারা বলছে।
“এরপরও কোন পদ্ধতিতে পাঠানো যায়, সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য আমাদের আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য তাকে বলেছি। তিনি বলেছেন যে, আমাদের অনুরোধ তার সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন।”
নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে হাই কমিশনারের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং বৈঠকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কর্তৃপক্ষ হাই কমিশনার নন। উনি যেটা বলেছেন, সেটি হচ্ছে তিনি তার সরকারের কাছে আমরা যেটি বলেছি, সেটা পৌঁছাবেন।”