স্থানীয় কাউন্সিলর বলছেন, পার্কের পরিবেশ ‘খারাপ হয়ে যাচ্ছিল’ বলেই স্থানীয় কিছু বাড়ির মালিক গাছ লাগিয়ে পার্কের পরিবেশ ঠিক রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন।
Published : 22 Aug 2022, 01:20 AM
ঢাকার মিরপুরের ১২ নম্বরের ডি ও ই ব্লকের মাঝের পার্কটি একসময় শিশুদের খেলাধুলা আর স্থানীয়দের অবসর বিনোদনের জায়গা ছিল, এখন সেখানে তালা ঝুলিয়ে ভেতরে চলছে চাষাবাদ।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীনে এই পার্কে এখনও মহামারীর লকডাউনের নোটিস ঝুলছে। ভেতরের একটি বড় অংশে গড়ে তোলা হয়েছে পেঁপে বাগান। আরেক পাশে করা হয়েছে বীজতলা।
এছাড়া কচু, পুঁইশাক, আদা, লেবু, কলা, পেয়ারা, সজনে, জাম্বুরা ও মাল্টা গাছও লাগানো হয়েছে পার্কের বিভিন্ন অংশে। এসব দেখাশোনার জন্যও লোক রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন স্থানীয় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
ই ব্লকের কিডজ ক্যাম্পাস স্কুলের অধ্যক্ষ রাবেয়া সুলতানা বললেন, পার্কটি এভাবে বন্ধ রাখায় শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জায়গাটুকু হারিয়ে গেছে।
“এখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করত। এলাকার মানুষজন হাঁটত। তারা একটা বিনোদনের জায়গা পেত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এটা বন্ধ করে রেখেছে। ওইটুকু খোলা জায়গা, সেটাও মানুষ হারিয়েছে।”
প্রায় আধা কিলোমিটার দীর্ঘ পার্কের পাঁচটি অংশের চারটিতেই তালা ঝুলছে। পার্ক কমিটির নামে সেখানে প্রবেশ বন্ধ রাখার নোটিস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরের অংশে বাঁশের বেড়াও দেওয়া হয়েছে।
বিহারী ক্যাম্প সংলগ্ন পার্কের অংশটি এর বাইরে থাকলেও সেখানে রয়েছে ওয়াসার পানির পাম্প, উন্মুক্ত জায়গা খুব কম। পার্কের বটতলা সংলগ্ন অংশটিকে আর পার্ক হিসেবে চেনার উপায় নেই।
দোলনা, স্লাইডসহ শিশুদের খেলার বিভিন্ন রাইড ছিল পার্কে। সেগুলোর কিছু কিছু সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেগুলো আছে, রশি বেঁধে ও বস্তা রেখে সেগুলো ব্যবহারের অনুপোযোগী করে রাখা হয়েছে।
চাষাবাদের পাশাপাশি নির্মাণ সামগ্রী রাখার কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে এ পার্ক। পাশের রাস্তাতেও রাখা হচ্ছে নিমার্ণ সামগ্রী।
পার্কের দুই অংশে কয়েকটি দোকানও বসানো হয়েছে, এজন্য নিয়মিত চাঁদা দিতে হচ্ছে জানালেও কারা সেই টাকা নিচ্ছে- তা বলতে চাননি দোকানিরা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর পার্কের পশ্চিম অংশে গাছ লাগানোর কথা বলে ‘লকডাউন’ নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পার্ক কমিটির নামে একে একে চারটি অংশই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তারা বলছেন, পার্কটি আসলে দখল করেছেন স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী। তবে তারা পার্ক কমিটির নাম ব্যবহার করছেন।
পার্কের পাশেই ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুল (ডিপস)। সেই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইরফান বললো, পার্কে ঢুকলেই ‘সমস্যা করে’। কয়েকজন বাড়িওয়ালা ধমকায়।
“তারা দারোয়ান রেখেছে পার্কের জন্য। সে সারাদিন পার্কে পাহারা দেয়। বলে পার্কে নাকি লকডাউন চলছে।”
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে ওই পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত খেলতে যেত ইরফান। মহামারীর সময় একদিন হঠাৎ তারা দেখতে পায় পার্কেও ‘লকডাউন দিয়ে দিয়েছে’, গেটগুলো বন্ধ।
পার্ক সংলগ্ন লিটল ফ্লাওয়ারস প্রিপারেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী ফারহান রহমানের মা আফসানা রহমান বলেন, “আগে বাচ্চারা পার্কে অ্যাসেম্বলি করত। ওদের স্কুলে তো মাঠ নেই, এই পার্কে বাচ্চারা ছোটাছুটি করত, খেলাধুলা করত। একটু খোলা জায়গা ছিল। সেটাও বন্ধ হয়ে গেলে।”
পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতির মধ্যে পড়েছে ডি ব্লক ও ই ব্লকের শিশুরা। খোলা জায়গা না পেয়ে কিছু শিশুকে রাস্তায় খেলতে দেখা গেছে।
রোববার বিকালে রাস্তায় খেলতে আসা কয়েকজন শিশু জানায়, পার্কের বাউন্ডারি টপকে তারা খেলার চেষ্টা করে, তাতে গালমন্দ শুনতে হয়।
ই ব্লকের কিডজ ক্যাম্পাস স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়াত আবদুল্লাহ বললো, “আমাদের বাসার সামনেই পার্ক। কিন্তু ওটায় তো তালা দেওয়া। সেজন্য বিকালে রাস্তায় খেলি। কিন্তু রিকশা-গাড়ির কারণে ঠিকমত খেলা যায় না।
“আম্মুও বকাঝকা করে, যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায়। কিন্তু বাসায় তো ভালো লাগে না।”
কিডজ ক্যাম্পাস স্কুলের অধ্যক্ষ রাবেয়া সুলতানা বলেন, “এখানে দোকান বসে গেছে। বখাটে ছেলেদের আড্ডার জায়গা হয়েছে। কিন্তু সেজন্য পার্ক বন্ধ করে দেওয়া হবে, সেটা তো ঠিক না। অবশ্যই খুলে দিতে হবে।”
স্থানীয় বাসিন্দা রুবেল তালুকদার বলেন, “কয়েকজন অতি উৎসাহী বাড়িওয়ালা পার্ককেও নিজেদের সম্পত্তি ভাবছেন। সেখানে অন্য কেউ ঢুকবে সেটা তারা সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু তারা তো পার্কের মালিক না।
“বাড়ির ছাদ আর পার্ক যে এক নয়, সে কাণ্ডজ্ঞানটুকুও তাদের নেই। সিটি করপোরেশনের উচিত পার্কটি সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া।”
আগে বাচ্চাকে নিয়ে নিয়মিত পার্কে যেতেন ব্যাংক কর্মকর্তা শহীদ হোসেন। এখন আর সে সুযোগ নেই বলে জানালেন তিনি।
শহীদ বলেন, পার্কে নানা বয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে পারত তার ছেলে। নানা ধরনের রাইড ছিল সিটি কর্পোরেশনের। বিভিন্ন দিবসে পার্কে লাইটিং হত। একটা বিনোদনের জায়গা ছিল। কিন্তু সেটা বন্ধ হয়ে গেল। এখন বাচ্চাদের সময় কাটে চার দেয়ালের ভেতরে।
“পুরা এলাকায় এখন খোলা জায়গা বলতে কেবল একটি মাঠ আছে। কিন্তু বড়রা সেখানে খেলে। ছোট বাচ্চাদের জন্য তো সেখানে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।”
ই-ব্লক ৩৩ নম্বর রোডের এক দোকান মালিক এই দখলদারি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, “জোর যার মুল্লুক তার। প্রভাবশালীরা পার্ক বন্ধ করে রেখে দিছে। বাচ্চাদের যেতে দেয় না, অথচ দোকান ভাড়া দিয়ে রাখছে। এই দোকান থেকে তো নিশ্চয় টাকাও ইনকাম করে। কিন্তু যাদের জন্য এই পার্ক, তাদেরকেই ঢুকতে দেয় না।”
পার্ক কমিটির কোষাধ্যক্ষ জহিরউদ্দিন লস্করের দাবি, পার্কের পরিবেশ সুন্দর রাখার জন্য তারা এ কাজ করছেন।
“সিটি কর্পোরেশন থেকে একটি এনজিওর মাধ্যমে পার্কে কিছু খেলার সরঞ্জাম দিয়েছিল স্থাপনের জন্য, কিন্তু কিছু রাজনৈতিক কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। এখন আমরা নিজেরাই পার্ক ঠিক করছি।
“কিছু সন্ত্রাসী পার্কটাকে বাজার করে ফেলেছিল, সেটাকে অনেক কষ্ট করে আমরা উঠিয়েছি। লকডাউনের পরে আমরা পার্ক ঘিরে গাছ লাগিয়ে দিয়েছি।”
তালা দিয়ে না রাখলে বাজার বসে যাবে মন্তব্য করে স্থানীয় এই বাড়ি মালিক বলেন, “লকডাউনের জন্য তো সব পার্ক সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল, তখনই আমরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নয়তো বাজার উঠাতে পারতাম না। এই বিষয়গুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা পার্ক খুলে দেব না।”
পার্কটি বন্ধ রাখার কথা স্বীকার করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই পার্কে অবৈধভাবে মার্কেট, দোকান-পাট বসানো হত। গাঁজাখোররা আড্ডা দিত।
“পার্কের পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল বলেই স্থানীয় কিছু বাড়ির মালিকরা এখানে গাছ লাগিয়ে পার্কের পরিবেশ ঠিক রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন।”
পার্কটিতে শিশু বা স্থানীয়দের কেন প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “বাচ্চারা গাছ নষ্ট করে ফেলবে তাই এখন পার্ক বন্ধ রাখা হয়েছে, গাছগুলো কিছুটা বড় হলে এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।”
গাছ কমছে
কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন গাছ বাঁচাতে পার্কে সাধারণের প্রবেশ বন্ধ রাখার দাবি করলেও স্থানীয়রা বলছেন, পার্ক বন্ধ রাখার পর থেকে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
সম্প্রতি পার্কে কয়েকজন শ্রমিককে গাছ কাটতে দেখা গেছে। পার্ক কমিটির নির্দেশে মরা গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
স্থানীয় বাসিন্দা সৌরভ বলেন, “পার্ক কমিটি গাছ কেটে নিচের জায়গা ব্যবহার করছে। পার্কের পশ্চিম দিকের দুই অংশে গাছ বেশি কমে গেছে। তাদের তো পার্কের গাছ কাটার কোনো অধিকার নেই। কীভাবে তারা এগুলো করছে সেটা বোধগম্য নয়।”
ডি ব্লকের এই বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কয়েকজন ব্যক্তি এতবড় একটা পার্ক জিম্মি করে রেখেছেন। তাদের কিছু বললে জানায়, কাউন্সিলরকে বলেই তারা পার্কে কাজ চালাচ্ছেন।”
গাছ কাটার বিষয়ে কাউন্সিলর সাজ্জাদের ভাষ্য, “যে গাছটি কাটা হয়েছিল, সেটা মরা গাছ ছিল। তাই কেটে ফেলা হয়েছে। আর কোনো গাছই কাটা হয়নি।”
পার্ক বন্ধ করে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, “আমরা বিষয়টি দেখব, কেউ পার্কটি দখল করে রেখেছে কিনা। কেউ দখল করে রাখলে আমরা এটিকে দখলমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম পার্ক বাঁচানোর জন্য সবসময়ই সরব। বিভিন্ন সময় তিনি পার্কে অন্যদের সঙ্গে খেলতেও নেমেছেন, যা সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
মিরপুরের ওই পার্ক নিয়ে প্রশ্ন কলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সিটি কর্পোরেশনের পার্ক সিটি কর্পোরেশনের মত চলবে। সিটি কর্পোরেশনের পার্ক কেউ বন্ধ করলে অ্যাকশন নেওয়া হবে।”