পানি লাইনে আসে না, ওয়াসায় কিনতে গেলেও মেলে না

প্রচণ্ড গরমে যখন জনজীবন অস্থির, তখন ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানির জন্য হাহাকার চলছে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2023, 06:14 PM
Updated : 20 April 2023, 06:14 PM

মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে মিরপুরে ঢাকা ওয়াসায় মডস অঞ্চল-১০ এর পানির পাম্পে এসেছিলেন পূর্ব কাজীপাড়া মাদ্রাসা এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মো. রিয়াজউদ্দিন আহমেদ।

ঘামে মুখচোখ চিটচিটে অবস্থায় তিনি জানালেন, গত তিনদিন ধরে বাসায় পানি নেই। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পানির সংকট হওয়ায় চরম বিপদে পড়েছেন। খাওয়া-গোসলসহ প্রতিদিনের সব কাজই আটকে যাচ্ছে।

ওয়াসার অভিযোগ কেন্দ্রে পানির জন্য সিরিয়াল দেওয়ার কথা জানিয়ে এই প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, তার সিরিয়াল নম্বর ৮১। ফলে ওইদিন পানি পাবেন কি না অনিশ্চয়তায় আছেন।

অভিযোগ দেওয়ার পর যে পাম্প থেকে ওয়াসার পানিবাহী গাড়ি ভরা হয় সেখানে এসেছেন রিয়াজউদ্দিন।

তার ভাষায়, “আমরা ওয়াসার পাম্পে গেছিলাম, তারা বলছে লাইনে পানি নাই। এই অবস্থা আশপাশের অনেক বাসায়। আজকা সকাল থেকে ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, পানি আসে নাই। ওজু করতে পারি না, বাথরুম করতে পারি না, খাওয়ার পানি নাই। গোসল তো দূরের কথা।”

গত কয়েকদিন ধরেই সারাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। ঢাকায় গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে থাকছে।

তীব্র এই গরমের মধ্যে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় পানির সংকটে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ।

এদিকে তীব্র গরমে পানির স্তর কিছুটা নিচে নেমে যাওয়ায় উৎপাদন কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাশাপাশি পানির ব্যবহার বেড়েছে; বড় কোনো বিপর্যয় না হলেও ‘অপচয়ের কারণে’ সংকট তীব্র হচ্ছে বলে দাবি করছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।

মিরপুর ৬ ও ১১ নম্বরের কিছু এলাকা, কাজীপাড়া, পশ্চিম আগারগাঁও, মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার হাউজিং, আদাবর, নবোদয় হাউজিং, মহাখালীর আরজতপাড়া, নাখালপাড়া, ভাটারার নূরের চালা, মাতুয়াইল, জুরাইনসহ কয়েকটি এলাকায় গত কিছুদিন ধরেই পানির সংকট চলছে।

সংকট কতটা তীব্র তা মঙ্গলবার ঢাকা ওয়াসার কয়েকটি মডস (মেনটেইন অপারেশন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সাপ্লাই) কার্যালয় ঘুরে দেখা গেছে। সেখানকার পানিবাহী গাড়িগুলো একটার পর একটা বিভিন্ন জায়গায় পানি নিয়ে যাচ্ছে।

কারও বাড়িতে পানি না থাকলে ওয়াসার অভিযোগ কেন্দ্রে জানানোর পর এসব কেন্দ্রের পাম্প থেকে গাড়িতে করে পানি পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, অভিযোগ জানিয়ে অপেক্ষায় থাকলেও পানির গাড়ি আসছে না। 

মঙ্গলবার দুপুরে মিরপুর বাংলা কলেজের পাশে মডস অঞ্চল- ৪ এ গিয়ে দেখা গেছে, ওয়াসার পানিবাহী গাড়িগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সেখানে দায়িত্বরত ওয়াসার কর্মীরা জানান, আগারগাঁও, মিরপুর ৬, মধ্য মনিপুর এলাকা থেকে বেশি অভিযোগ আসছে। সেসব এলাকায় গাড়ি যাচ্ছে বেশি। প্রতিদিন একশর বেশি রিকুইজিশন আসছে পানির জন্য, কিন্তু দেওয়া যায় সর্বোচ্চ ৬০টি গাড়ি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার একজন কর্মী বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে পানির ক্রাইসিস অনেক বেড়ে গেছে। মানুষজন ভোর ৪টা থেকে আমাদের এখানে আসে সিরিয়াল দেওয়ার জন্য। পাঁচটি গাড়িতে ৬০টা ট্রিপ দেওয়া যায়, কিন্তু চাহিদা আসে একশর বেশি। এজন্য সবাই পানি পায় না।”

মডস অঞ্চল- ৩ এ পানির সংকট সবচেয়ে বেশি। এই অঞ্চলের আওতায় পড়েছে পুরো মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, মনিপুরীপাড়া, ফার্মগেইট, সংসদ ভবন এলাকা। জানা গেছে, এখানকার মোহাম্মদীয়া হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, শেখের টেক, রফিক হাউজিং, আদাবরের কয়েকটি এলাকায় পানির তীব্র সংকট।

মঙ্গলবার সেখানে পানির সিরিয়াল দিতে আসা নবোদয় হাউজিংয়ের একটি বাড়ির মালিকের ছেলে শোভন জানান, ওই এলাকায় ওয়াসার পানির পাম্পের সংস্কার চলছে গত ২০-২৫ দিন ধরে। এ কারণে পানি পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। গত এক সপ্তাহ ধরে লাইনে একদমই পানি নেই।

“এই রোজার দিন। মানুষ কীভাবে রান্নাবান্না করবে? কী খাবে? খুবই একটা দুর্দশায় পড়েছি। আবার ওয়াসার গাড়ির সিরিয়ালও পাচ্ছি না। উনাদের পায়ে পড়া বাকি আছে। আর পানি কিনে কতদিন চলব?”

পশ্চিম আগারগাঁওয়ের বনলতা আবাসিক এলাকার কয়েকটি বাড়িতে গত কয়েকদিন ধরে এই সঙ্কট চলছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, লোকজন কাছের অন্যান্য বাড়ি থেকে পানি আনছেন।

সেখানকার একটি বাড়ির বাসিন্দা এহসানুর রহমান বলেন, এসব বাড়িতে গত ১৫ দিন ধরে কোনো পানি আসছে না।

“ঢাকা ওয়াসায় অভিযোগ করেছি, লাইনম্যান আসে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। পানির এমন সংকট, মনে হয় নরকে আছি।”

মহাখালীর আরজতপাড়া এলাকায়ও পানি নেই কয়েক সপ্তাহ ধরে। এই এলাকায় পানির পাম্পের কাজ চলায় এই সমস্যা হচ্ছে। ফলে ঘরে পানি না আসায় অনেকে পানির পাম্পে গিয়ে বোতল বা বালতি করে পানি আনছেন।

আরজতপাড়ার বাসিন্দা ‍মুনীরুল ইসলাম বলেন, এই গরমে পানি না থাকার ভোগান্তি অনেক। আর বোতল আর বালতিতে করে কতটুকুই বা পানি আনা যায়।

ওয়াসার গাড়ি থেকে পানি কিনতে গিয়েও অতিরিক্ত অর্থ দিতে হওয়ার কথা বলেন তিনি।

ওয়াসার পানির একটি গাড়ির নির্ধারিত দাম ৫০০ টাকা। কিন্তু সংকটকালে এখন ১ হাজার টাকার বেশি দিতে হচ্ছে বলে তার অভিযোগ।

ভাটারার মৈত্রী সড়কের কয়েকটি বাড়িতে পানি আসে না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।

ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুল হামিদ বলেন, ওই এলাকায় নূরের চালা বাজার ও ভাটারা থানার পাশের পাম্প থেকে পানি আসে। দুটি পাম্পই এলাকা থেকে কিছুটা দূরে; সড়কের পানির লাইন তিন ইঞ্চি হওয়ায় প্রবাহও কম।

“দুদিক থেকেই পানি আসতে আসতে আমাদের বাসায় এসে পৌঁছায় না। শীতকালে কিছুটা পানি পাওয়া যায়। গরমকালে অবস্থা খুব খারাপ হয়। বারিধারা জে ব্লকের পাম্প থেকে আমাদের এলাকায় ৬টায় পানি আসবে বলা হলেও ১২টায়ও পানি পাই না। আশপাশের বাড়ি থেকে ড্রাম, বালতি দিয়া পানি এনে কাজ চালাচ্ছি।”

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পানির এই সংকটের জন্য নগরবাসীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গরমের কারণে পানির স্তর কিছুটা নিচে নেমে যাওয়ায় সরবরাহে প্রভাব পড়েছে। উৎপাদন কিছুটা কমেছে, পাশাপাশি পানির ব্যবহারও বেড়েছে।

“বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় না হলেও কয়েকটি এলাকায় আগে থেকে যেসব এলাকায় সংকট ছিল, সেখানে আবার সমস্যা দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে তিন নম্বর অঞ্চলে।”

এলাকাওয়ারি হিসেবে তিনি বলেন, “আদাবর ও পিসি কালচার হাউজিং এলাকায় সংকট বেশি। সেখানে তারা আবাসন করেছেন, কিন্তু পাম্প বসানোর জায়গা রাখেনি।

“কিছু এলাকায় বিদ্যুৎবিভ্রাট মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে আমাদের এত চেষ্টার পরও পানি রেশনিং করতে হচ্ছে সেসব এলাকায়। তিন থেকে চার ঘণ্টা পানি না থাকলেই ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।”

সংকটের মধ্যে পানির অপচয় বেশি হচ্ছে বলেও দাবি করেন ওয়াসার এমডি।

তিনি বলেন, “এখন ট্যাপ ছাড়লে প্রথমে কিছুক্ষণ গরম পানি আসে। তো মানুষ কিছুক্ষণ পানি ছেড়ে রাখে। এমনিতেই আমাদের পানির টানাপড়েন। এভাবে পানি অপচয় করায় সমস্যা আরও বেড়েছে।”