“ধলপুর ময়লার ট্রাক থাইকা ময়লা রাস্তায় পইড়া যায়, আর ময়লা পানিও পড়ে; খোদার তিরিশ দিন কেউ না কেউ পিছলাইয়া পইড়া যায়,” বলেন সড়কের পাশের এক দোকানি।
Published : 19 Apr 2024, 01:32 AM
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী যানবাহন থেকে চুঁইয়ে পড়া তরল বর্জ্য বিপদে ফেলছে নগরবাসীকে। দুর্গন্ধযুক্ত বর্জ্য সড়কে পড়ে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনই সড়ক পিচ্ছিল হওয়ায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে দৈনিক ৩ হাজার ২০০ টন বর্জ্য সরিয়ে নেওয়া হয় আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩ হাজার টন বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হয় মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিলে।
খোলা ট্রাক, ডাম্প ট্রাক, কনটেইনার ক্যারিয়ার, আর্মরোল ক্যারিয়ার ও কমপ্যাক্টর ট্রাকে করে এসব বর্জ্য পরিবহন করে থাকে দুই নগর সংস্থা। এর মধ্যে কমপ্যাক্টর ট্রাক ছাড়া বাকিগুলো দিয়ে তরল বর্জ্য চুঁইয়ে পড়ে।
বর্জ্য পরিবহনে ঝুঁকি
সম্প্রতি বনানীতে বিমানবন্দর সড়ক ও ১ নম্বর সড়কের মোড়ে একটি মোটরসাইকেল এবং একটি সাইকেল দুর্ঘটনায় পড়ে। এ ঘটনায় দুটি যানবাহনের আরোহীরা সামান্য আহত হন।
তাদের মধ্যে তাহসিন আহমেদ নামে এক তরুণ তার বন্ধুকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে কুড়িল থেকে শ্যামলী যাচ্ছিলেন। চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় হঠাৎই সড়কে আছড়ে পড়েন তিনি। সামান্য আহত হলেও খুব বেশি বিপদ হয়নি তার।
তাহসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সড়কে যে তরল বর্জ্য পড়েছিল তা দেখেননি, আর এটা যে এত পিচ্ছিল হয়ে আছে তাও বুঝতে পারেননি তিনি।
“কোনো কারণ ছাড়াই সামনের চাকা স্কিড (পিছলাইয়া পড়া) করে পড়ে গেছি। আছাড় খেয়ে পড়ার পর অন্তত ১৫ গজ পর্যন্ত আছড়ে গেছি। ভাগ্য ভালো রাস্তা পিছলা হওয়ায় শরীর ছিলে যায়নি। আমাদের তেমন ক্ষতি হয় নাই। কিন্তু পেছনে গাড়ি থাকলে আমি এখানেই মারা পড়তাম। এটা দেখার কেউ নাই।”
তাহসিনের সঙ্গে কথা বলার সময় ঠিক ওই জায়গায় আরেক সাইকেল আরোহী পড়ে যান। ডান হাতে সামান্য ব্যথাও পান তিনি।
বেলাল হোসেন নামে ওই সাইকেল আরোহী বনানীতে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অফিস শেষে সাইকেলে করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।
বেলাল বলেন, “সাইকেল নিয়া আসতে লাগছিলাম। পিছলা দেইখা ব্রেক করছিলাম। কিন্তু এর আগেই পইড়া গেছি।”
ওই ঘটনার পর কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বনানীর ১ নম্বর ও ২ নম্বর সড়ক ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কয়েকটি ময়লাবাহী ট্রাক বনানীর চেয়ারম্যান বাড়িতে বিমানবন্দর সড়কে প্রবেশ করে। ওই ট্রাকগুলো যাওয়ার সময় ট্রাক থেকে দুর্গন্ধযুক্ত পিচ্ছিল তরল পদার্থ চুঁইয়ে সড়কে পড়ে। ফলে ওই জায়গাটিতে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়।
মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি মাঠের কাছের সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থেকে সাভারের আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে বর্জ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত একটি ট্রাকের চালক জয়নাল আবেদীন জনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকাল থেকে ভ্যানে করে ময়লা-আবর্জনা এনে ফেলা হয় এসটিএসে। বর্জ্যের সঙ্গে নানা ধরনের পচনশীল দ্রব্য, গৃহস্থালি বর্জ্য, রান্নাঘরের বর্জ্য, উচ্ছিষ্ট খাবারও থাকে।
“সারাদিন পইড়া থাকা এইসব ময়লা থেইকা পানি ছাইড়া দেয়। আমরা যহন ট্রাকে লোড করি, তখন এইগুলো রাস্তায় পড়ে।”
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব ট্রাক মিরপুর রোড, মাজার রোড হয়ে গাবতলী দিয়ে আমিনবাজার যায়। ফলে ওই সড়কের বিভিন্ন স্থানে তরল বর্জ্য পড়ে থাকে। সন্ধ্যার পরই ওই সড়কটিতে গেলে দুর্গন্ধ নাকে আসে।
গত ৪ এপ্রিল রাতে ঢাকার তেজগাঁও-বিজয় সরণি ওভারপাস হয়ে তিনটি বর্জ্যবাহী ট্রাক গাবতলীর দিকে যাচ্ছিল। ওই ট্রাক তিনটি অনুসরণ করে দেখা গেছে, তিনটি ট্রাক থেকেই তরল বর্জ্য চুঁইয়ে সড়কে পড়ছে। চলন্ত অবস্থায় সেটা খুব বোঝা যাচ্ছে না, তবে ট্রাকগুলো সিগন্যালে থামলেই এ বর্জ্যে সড়ক ভেসে যাচ্ছে।
এ ধরনের ময়লা পানির কারণে মোটরসাইকেল আরোহীরা বেশি ভয়ে থাকেন বলে জানালেন ভাসানটেক এলাকার বাসিন্দা সোহরাব উদ্দিন।
এই বাইক চালক বলেন, ঢাকার বিভিন্ন সড়কে এ চিত্র দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি নোংরা পানি পড়ে গাবতলী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায়।
“ময়লার ট্রাক থেকে প্রায়ই নোংরা পানি পড়ে। এই পানি খুবই পিছলা। ওইসব ট্রাকের পিছন পিছন যাওয়া খুব রিস্কি, চাকা পিছলায়া যায়। আমি কখনও পড়ি নাই, কিন্তু একবার একজনকে বাইক নিয়া পইড়া যাইতে দেখছি।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ফেলা হয় মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে। বিভিন্ন যানবাহন সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, গোলাপবাগ হয়ে ডেমরা সড়ক ধরে বর্জ্যবাহী যানবাহনগুলো মাতুয়াইল যায়।
৬ এপ্রিল রাতে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী থেকে মাতুয়াইল পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বর্জ্যবাহী ট্রাক থেকেই তরল বর্জ্য চুঁইয়ে পড়ছে। কোনো কোনো ট্রাক থেকে পানির পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনাও সড়কে পড়ছে। বিশেষ করে সায়েদাবাদ থেকে যাত্রাবাড়ী হয়ে মাতুয়াইল পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে অনেক আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ধলপুর মোড়ের সড়কের পাশের চা দোকানি সালমা বলেন, প্রতিদিন এই সড়ক দিয়ে অসংখ্য বর্জ্যবাহী ট্রাক যায়। এসব ট্রাক থেকে নোংরা পানি সড়কে পড়ে। সড়ক পিচ্ছিল হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
“এইখানে একটা বিট (স্পিড ব্রেকার) আছে, ওইটার ধাক্কা খায়া ময়লার ট্রাক থাইকা ময়লা রাস্তায় পইড়া যায়। আর ময়লা পানিও পড়ে। খোদার তিরিশ দিন কেউ না কেউ পিছলাইয়া পইড়া যায়। আমি সারা রাইত দোকান করি। আমি রেগুলারই এই ঘটনা দেখি।"
যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে কাজলা পর্যন্ত দুটি বর্জ্যবাহী ট্রাকের পেছন পেছন গিয়ে দেখা গেছে, দুটি ট্রাক থেকেই তরল বর্জ্য চুঁইয়ে পড়ছে। কাজলা ভাঙ্গাপ্রেস এলাকায় গিয়ে ট্রাক দুটি অন্তত ১৫ মিনিট যানজটে আটকে ছিল। ওই সময় দুর্গন্ধযুক্ত পানি পুরো সড়কে পড়ে; বাধ্য হয়ে লোকজনকে নাকমুখ চেপে ধরে থাকতে হয়।
কাজলা এলাকার বাসিন্দা আবু তালেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসব ময়লা পড়ে যাওয়ায় রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায়। তিনি অনেককে পড়ে যেতে দেখেছেন।
“চোখের সামনেই অনেক মোটরসাইকেলকে আরোহীসহ পিছলে পড়তে দেখেছি। হাঁটু, পা, হাতের কনুই ছিলে যাওয়া নিত্য ঘটনা। কয়েকজনকে তো আমি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় পড়ে গিয়ে অন্য যানবাহনের নিচে চাপা পড়ার আশঙ্কা থাকে।”
ডিএসসিসির এক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিদর্শক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসটিএস থেকে বিকালের পর কনটেইনার, খোলা ট্রাক, কমপ্যাক্টর এবং ডাম্প ট্রাকে করে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হয়।
“বর্জ্য পরিবহনের জন্য সবচেয়ে ভালো পরিবহন হলো কম্প্যাক্টর। এটাতে বর্জ্য পড়ে যাওয়া বা তরল বের হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাকি যানবাহন থেকে বর্জ্য পড়ে যায়, তরল বর্জ্যও চুঁইয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের তো এতো পরিমাণ কমপ্যাক্টর নাই।”
বিপদ কতটা
সড়কে পড়া তরল বর্জ্যে দুর্ঘটনার পাশাপাশি পরিবেশের যেমন দূষণ ঘটছে, তেমনই মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি করছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের (পরিজা) সভাপতি আবদুস সোবহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়ম মেনে বর্জ্য পরিবহন করলে তরল বর্জ্য এভাবে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়। এই বর্জ্য পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
“এসব যে শুধু গৃহস্থালি বর্জ্য তা না, শিল্প কারখানার বর্জ্য থাকে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে এর সঙ্গে হাসপাতাল, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের বর্জ্যও থাকে। যদিও বলা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল বর্জ্য অপসারণ করে। কিন্তু সেটা খুবই কম।”
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, “এসব বর্জ্য পরিবহন করার সময় সড়কে পড়লে লোকজন আছাড় খাওয়ার ভয় থাকে। তার চেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে নানা ধরনের জীবাণুবাহী এসব বর্জ্য শুকিয়ে ধুলা হয়, যা বাতাসে উড়ে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।”
তরল এসব বর্জ্য শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এগুলো শুধু প্রাকৃতিক বর্জ্য না, এর মধ্যে কেমিক্যাল বর্জ্য থাকতে পারে, বায়ো-মেডিকেল বর্জ্য থাকতে পারে। ফলে এটা অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।”
সমাধানে কী করছে দুই সিটি
ডিএনসিসি জানিয়েছে, ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডের বর্জ্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অপসারণ করে সংস্থাটি। ১৪৫টি যানবাহনে করে বর্জ্য অপসারণ করা হয়। এরমধ্যে ৫৭টি কমপ্যাক্টর, বাকিগুলো খোলা ট্রাক এবং কনটেইনার।
২৬টি ওয়ার্ডের বর্জ্য অপসারণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে ডিএনসিসি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা ট্রাকে করে বর্জ্য পরিবহন করে। তাদের কোনো কমপ্যাক্টর নাই।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্জ্যবাহী গাড়ি থেকে তরল রাস্তায় পড়ার বিষয়টি নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন। এটি সড়কে সমস্যা তৈরি করছে। এটি সমাধানে ডিএনসিসি কাজ করছে।
“এই লিচেট (চুঁইয়ে পড়া বর্জ্য) একটা বিপদ। কমপ্যাক্টর দিয়ে পরিবহন করলে এটা হয় না। কিন্তু খোলা ট্রাকে করলে এটা হয়। এজন্য আমরা আরও আটটি কমপ্যাক্টর কিনছি, মাস দুয়েকের মধ্যে জাপান থেকে এগুলো চলে আসবে। এছাড়া আমরা এসটিএসগুলোকে আরও স্মার্ট করার জন্য জাপানের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছি। ওখানে একটা কনভেয়ার বেল্টের মতো থাকবে, সেখানে বর্জ্যগুলো কমপ্যাক্ট হয়ে ট্রাকে উঠবে। তখন চুঁইয়ে পানি পড়ার বিষয়টি আর থাকবে না।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এসব বর্জ্য অপসারণ করে। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নেই। ট্রাকের পাশাপাশি বর্তমানে ২২টি কমপ্যাক্টর আছে। আরও ৩০টি কমপ্যাক্টর কেনার প্রক্রিয়া চলছে।
“এত বছরেও আমাদের প্রয়োজনীয় কমপ্যাক্টর নেই। কিনতে হবে। এগুলো কেনার জন্য একটা দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। আমরা কিছু কমপ্যাক্টর কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছি। আমি যতদূর জানি, সেগুলো কেনার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এগুলো যুক্ত হলে সমস্যাটির কিছুটা সমাধান হবে।”