বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারি উদ্যোগ: এবার ভিন্ন চিত্র

অসহনীয় লোডশেডিংয়ের পর সরকার দুই সপ্তাহ সময় চাইছে, জনগণকে সাশ্রয়ী হতে আহ্বান জানাচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গত বছর যেমন এক গুচ্ছ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এসেছিল, এবার তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2023, 04:48 PM
Updated : 8 June 2023, 04:48 PM

জ্বালানি সঙ্কটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ঠিক এক বছর আগে যখন লোডশেডিং হয়েছিল, তখন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকার নানামুখি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এবার বিদ্যুতের চাহিদা ও লোডশেডিং বেশি হলেও সরকারের তরফ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

তীব্র লোডশেডিংয়েও বিপণীবিতান বা এই ধরনের স্থাপনা খোলা থাকছে রাত ১০টা বা তার পরেও। যখন যার দরকার করছে আলোকসজ্জা। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের স্যুট টাই পরে অফিস না করার বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনাও আসেনি।

সচিবালয়ে একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, এক বছর আগের মত কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে প্রশাসনে কোনো আলোচনাও হয়নি।

অন্য একজন বলেছেন, গতবারের নির্দেশনা তুলে দেওয়া হয়নি। কিন্তু আসলে স্কুল কলেজে দুই দিনের ছুটি ছাড়া অন্য কোনো নির্দেশনা কার্যকর নেই।

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করে সরকার। ওই সিদ্ধান্তে গ্যাসভিত্তিক অনেকগুলো কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। পাশাপাশি তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও বন্ধ করে রাখতে হয়।

এলএনজির বাড়তি দাম অনেকটা কমার পর সরকার স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি কিনছে, আবার কাতারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি নতুন করে করেছে। চলতি গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ ঘাটতির মূল কারণ কয়লার অভাব।

বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি আর ডলার সঙ্কটের কারণে বিল বকেয়া পড়া এবং নতুন করে এলসি খুলতে না পারায় ১৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, গ্যাসভিত্তিক আরও বেশ কিছু কেন্দ্রের পর্যাপ্ত উৎপাদন হচ্ছে না জ্বালানির অভাবে।

এ অবস্থায় দিনে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা বিদ্যুৎখাতে বর্তমান সরকারের সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে।

সরকার দুই সপ্তাহ সময় চাইছে, জনগণকে সাশ্রয়ী হতে আহ্বান জানাচ্ছে, কিন্তু বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে প্রশাসনিক কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া হচ্ছে না।

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি সংকট কাটিয়ে দ্রুত কীভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। ‘শিগগিরই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে’, এমনটি ধরে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নতুন কোনো বিধিনিষেধ আরোপের চিন্তা আপাতত নেই।

গত বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ থেকে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। এই অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনা জারির বিষয়ে এখনো আমাদের কেউ কিছু বলেনি।”

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কাছ থেকে সরাসরি কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তিনি শুধু বলেন, “বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।”

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান মনে করেন, এবার লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেশি বলে সরকার এখন আর সাশ্রয়ের কথা বলতে পারছে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত বছরের তুলনায় এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। লোডশেডিং যদি সহনীয় পর্যায়ে থাকে, তাহলে পরে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিষয়ে কথা বলতে পারবেন। এখন আপনি কাকে সাশ্রয় করতে বলবেন? গ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এখন যদি তাকে সাশ্রয়ের কথা বলে সে তো মারতে আসবে।

“একটা মানুষ যদি ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেত, আর দিনে রাতে দুই ঘণ্টা করে চার ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হত, তাহলে সাশ্রয় করতে বলতে পারত। এখন কাকে সাশ্রয় করতে বলবেন? কে সাশ্রয় করবে? সাশ্রয় করারই তো কোনো সুযোগ নেই। তাই হয়ত সরকার এই সাশ্রয়ের বিষয়ে বলছে না। কয়লা, এলএনজি আমদানি করে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যাতে চালু থাকে সেসব বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে।”

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গত বছরের যত সিদ্ধান্ত

গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত করার সিদ্ধান্ত আসার পর সরকার বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেয়।

>> ১৯ জুলাই একনেকের বৈঠক সরকারি কর্মকর্তাদের স্যুট-কোট না পরা এবং এসির ব্যবহার সীমিত করার নির্দেশ আসে।

বৈঠক শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, “বিদেশি কোনো ডেলিগেট এলে তখন স্যুট-কোট পরা যাবে।”

>> ২০ জুন থেকে রাত ৮টায় বিপণী বিতানসহ সব ধরনের মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল কাঁচাবাজারও। পাড়া মহল্লায় সুপার শপসহ অন্য দোকানও বন্ধ হয়ে যায় এই সময়ের মধ্যেই।

>> ৭ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এক নির্দেশনায় বলা হয়, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত আলোকসজ্জা করা যাবে না। সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, শপিংমল, দোকানপাট, অফিস ও বাসাবাড়িও ছিল এর আওতায়।

সেদিনই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আরেক নির্দেশনায় বলা হয়, ঈদুল আজহা উপলক্ষেও আলোকসজ্জা করা যাবে না।

>> ২০ জুলাই সরকারি বিভিন্ন অফিসে জ্বালানির বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহার করতে বলা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর তখনকার মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস সেদিন বলেন, ‘‘অফিস-আদালতে আমরা বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে পারি, যেন উৎপাদনও খুব বেশি ব্যাহত না হয়। অফিসে যদি দুটি ফ্যানের জায়গায় একটি ফ্যান চালানো হয়, তাহলেও কিন্তু আমরা কাজ করতে পারব। সেজন্য আমরা সরকারি অফিসগুলোতে সহনীয় মাত্রায় ২৫ শতাংশ বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছি।”

একই দিন অনিবার্য না হলে শারীরিক উপস্থিতিতে সভা পরিহার করতে নির্দেশ দিয়ে বেশিরভাগ সভা অনলাইনে আয়োজন করার নির্দেশ আসে।

>> ১১ অগাস্ট বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দেশের একেক শিল্পাঞ্চলে সাপ্তাহিক ছুটি একেক দিনে করা হয়।

>> ২২ আগস্ট আসে দুটি নির্দেশ। সরকারি অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে ৫টার বদলে করা হয় ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। ব্যাংকের সূচি ঠিক হয় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা।

একই দিন সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে দুই দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি এখনও বলবৎ আছে।

চাহিদার চেয়ে উৎপাদনক্ষমতা বেশি, সঙ্কট কোথায়?

দেশে এখন ১৫৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। সরকারি হিসেবে চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

আর লোডশেডিং করতে হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে অতিগুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা বা কেপিআইয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয়। শিল্পেও যথাসম্ভব কম লোডশেডিং করতে হয়। ফলে কোপটা গিয়ে পড়ছে আবাসিকে।

৩০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলের অভাবে ভুগছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা নয় হাজার মেগাওয়াট হলেও দিনে গড়ে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।

পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে কয়লার অভাবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ। বাকি চারটির মধ্যে তিনটিতে কয়লার সংকট আছে। একটি কেন্দ্রের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহৃত হচ্ছে। ডলারের অভাবে কয়লা কিনতে না পেরে দুই দফা বন্ধ হয়েছিল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।

মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। গ্যাসভিত্তিক ৬৪টি কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পালাক্রমে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বাকি ৮ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে গড়ে উৎপাদিত হচ্ছে ৬ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি।

আটটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে এখন তিনটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। ফার্নেস তেলচালিত ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির অভাবে নিয়মিত উৎপাদন করতে পারছে না।

একটু ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, আগামী ১৫-১৬ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময় নিয়েছেন ১০ থেকে ১৫ দিন। তিনি জানিয়েছেন আজকালের মধ্যে ৫০০ মেগাওয়াট যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে।