আইনে বলা হয়েছে, কোনো চালকের ১২টি পয়েন্ট কাটা গেলে তার লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
Published : 27 Jun 2024, 01:39 AM
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে নিয়ম ভঙ্গের জন্য চালকের পয়েন্ট কাটার নিয়ম রাখা হলেও সে নিয়ম চার বছরেও চালু করতে পারেনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মোটরযান চালকের লাইসেন্সে ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকবে, ট্রাফিক আইন অমান্য করলে কাটা যাবে পয়েন্ট। কোনো চালকের ১২টি পয়েন্ট কাটা গেলে তার লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে বিআরটিএ জানিয়েছিল, ড্রাইভার্স লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটার জন্য একটি বিশেষায়িত সফটওয়্যার তৈরি করা হচ্ছে।
সে সময় বলা হয়েছিল, দুই মাসের মধ্যে সফটওয়্যার তৈরি করে পয়েন্ট কাটার কাজ শুরু হবে। প্রথমে শুরু হবে ঢাকায়, পরে সারা দেশে চালু করা হবে। বিআরটিএকে এ কাজে সহযোগিতা করবে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশ এখন বলছে, তারা তাদের সব কাজ গুছিয়ে রাখলেও বিআরটিএ এর কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ বলছে, তাদের সফটওয়্যারের কাজ এখনও চলছে। সেটা হয়ে গেলেই পয়েন্ট কাটা শুরু করা যাবে।
যে অপরাধে পয়েন্ট কর্তন
বাংলাদেশে ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন করে সরকার, তা কার্যকর হয় ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর। ওই আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, যে কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকবে। আইন অমান্য করলে পয়েন্ট কাটা যাবে।
কোন কোন অপরাধে একজন চালক পয়েন্ট খোয়াবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে আইনে।
• লাল বাতি অমান্য করে গাড়ি চালালে।
• পথচারী পারাপারের নির্দিষ্ট স্থানে বা এর কাছে বা ওভারটেকিং নিষিদ্ধ স্থানে ওভারটেক করলে।
• মোটরযান না থামিয়ে সরাসরি প্রধান সড়কে মোটরযান প্রবেশ করালে।
• সড়কে নির্দেশিত গতিসীমা লঙ্ঘন করলে।
• ইচ্ছাকৃতভাবে পথ আটকে বা অন্য কোনোভাবে অন্যান্য মোটরযানের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে।
• একমুখী সড়কে বিপরীত দিক থেকে মোটরযান চালালে।
• বেপরোয়া ও বিপজ্জনকভাবে মোটরযান চালালে এবং ওজনসীমা লঙ্ঘন করলে।
• মদ্যপ বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মোটরযান চালালে।
• বিধিমালা দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোনো নিয়ম ভঙ্গ করলে পয়েন্ট কাটা যাবে।
কোন অপরাধে কত পয়েন্ট কাটা হবে, তাও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন আইনে।
• ট্রাফিক সাইন ও সংকেতের বিধান লঙ্ঘন করলে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• মোটরযানের বাণিজ্যিক ব্যবহারসংক্রান্ত ধারা ৩১-এর বিধান লঙ্ঘনে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• গণপরিবহনে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন ও নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করলে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• কন্ট্রাক্ট ক্যারিজের মিটার অবৈধভাবে পরিবর্তন বা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করলে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• অতিরিক্ত ওজন বহন করে মোটরযান চালালে ২ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• মোটরযানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেলে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• নির্ধারিত শব্দমাত্রার অতিরিক্ত উচ্চমাত্রার কোনো রূপ শব্দ সৃষ্টি বা হর্ন বাজানো বা কোনো যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা হর্ন মোটরযানে স্থাপন করলে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• পরিবেশ দূষণ করলে বা ঝুঁকিপূর্ণভাবে মোটরযান চালালে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• মোটরযান পার্কিং ও যাত্রী বা পণ্য ওঠানামার নির্ধারিত স্থান ব্যবহার না করলে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• দ্রুতগতির মোটরযান সরাসরি মহাসড়কে প্রবেশের ক্ষেত্রে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• মোটরযান চলাচলের সাধারণ নির্দেশনা লঙ্ঘনের কারণে ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির চিকিৎসাসংক্রান্ত বিধান লঙ্ঘনের জন্য ১ পয়েন্ট কাটা যাবে।
• ইচ্ছাকৃতভাবে পথ আটকে বা অন্য কোনোভাবে অন্য মোটরযানের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে ২ পয়েন্ট কাটা যাবে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পয়েন্ট পদ্ধতি চালু করতে পারলে সড়কে শৃঙ্খলা আসত অনেকটাই। এটা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।
“এটা চালকদের ওপর এক ধরনের সফট ইমপোজমেন্ট হতে পারত। চালক যখন দেখবেন তার একটা পয়েন্ট কাটা গেছে, লাইসেন্স বাতিল হলে গাড়ি চালাতে পারবেন না; তখনই তিনি সতর্ক হয়ে যেতেন।”
উদ্যোগ আটকে আছে কেন
যেভাবে পরিকল্পনা হয়েছে, তাতে কোনো একজন চালক গাড়ি চালানোর সময় ট্রাফিক আইন অমান্য করলে ট্রাফিক পুলিশ ওই গাড়ি থামাবেন। তিনি চালকের লাইসেন্স-সংক্রান্ত সব তথ্য যাচাই করে দেখবেন। নতুন করা মামলার তথ্য চলে যাবে বিআরটিএর কাছে। বিআরটিএ ওই চালক কত পয়েন্ট খোয়ালেন, সেই তথ্য সংরক্ষণ করবে।
এভাবে একজন চালকের ১০ পয়েন্ট কাটা গেলে বিআরটিএ থেকে চালকের কাছে একটি সতর্কবার্তা পাঠানো হবে। এরপরও চালক সতর্ক না হলে, মামলার কারণে ১২ পয়েন্ট হারালে তার লাইসেন্সটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। লাইসেন্স বাতিল হওয়ার তথ্যও চালকের কাছে পাঠাবে বিআরটিএ।
এভাবে মামলা করে তথ্য পাঠানোর কাজ করবে পুলিশ। আর তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজটি করবে বিআরটিএ। এই পুরো কাজটি করার জন্য একটি সফটওয়্যার লাগবে। যেখানে পুলিশ এবং বিআরটিএর নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ থাকবে।
এই সংযোগ স্থাপনের কাজটিই এখনও সম্পন্ন হচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, পয়েন্ট কর্তনের ব্যবহারবিধি তারা পেয়েছেন। কিন্তু বিআরটিএ এর সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত না হওয়ায় মামলা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারছেন না তারা।
“পুলিশ প্রস্তুত। তবে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ যখন মামলা দেবেন, তার আগে চেক করতে হবে লাইসেন্সটা আসল বা হালনাগাদ কিনা, চালকের ঠিকানা এবং জন্ম তারিখ ঠিক আছে কিনা। দ্বিতীয়ত, ডিএমপি পয়েন্ট কেটে সেটা বিআরটিএকে পাঠিয়ে দেবে। লাইসেন্স বাতিলের কাজটি করবে বিআরটিএ। কোনো লাইসেন্স বাতিল হলে সেই তথ্যও বিআরটিএ পুলিশকে জানাবে। এ কাজগুলো বিআরটিএর সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সুরাহা করতে ডিএমপি থেকে বিআরটিএর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমেও গত বছরের ডিসেম্বরে ডিএমপি কার্যালয়ে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মনিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশ চালকদের লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটার বিষয়টির পক্ষে আছে। তবে প্রক্রিয়াটি এখনও চালু হয়নি, আলোচনায় আছে।
“পয়েন্ট কাটতে হলে ডেটাবেইজ থাকতে হবে। বিআরটিএর সঙ্গে কানেক্টিভিটির বিষয় আছে। উদ্যোগটা বিআরটিএকে নিতে হবে। আমাদের দিক থেকে আমরা তাগাদা দিচ্ছি। কিন্তু কো-অপারেশন, কো-অর্ডিনেশন লাগবে। পয়েন্ট কর্তন করা আমাদের বিষয় নয়। যে সংস্থা লাইসেন্স দেয়, নবায়ন করে, এটি তাদের কাজ। তাদের ওখানে ডেটাবেইজ থাকবে, তারা আমাদের নোটিফাই করবে। সুতরাং কানেক্টিভিটির বিষয়টি জরুরি।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআরটিএর পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। সিস্টেমের কাজ চলছে। এখানে পুলিশের সঙ্গে কানেক্টিভিটি ইন্টিগ্রেশনের বিষয় আছে। সেটার কাজ চলছে। ডিএমপি এই কাজটি শুরু হয়েছে। ডিএমপির সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন হলে আমরা পাইলটিং করব। পরে সারাদেশে।”
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পয়েন্ট কাটার জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার যে অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করবে, সেটি তৈরির কাজ শেষ। কিন্তু এটা এখনও চালু করা হয়নি।
“এটা ম্যানুয়ালি কার্যকর আছে। অ্যাপ লঞ্চ করি নাই কারণ ঢাকায় অটোমেটেড ট্রাফিক সিস্টেম চালু করার কথা। এ প্রকল্পটি করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমাদের এই অ্যাপটি করা হয়েছে সারা দেশের জন্য। সেটার সঙ্গে ঢাকার অটোমেটেড ট্রাফিক সিস্টেমের সঙ্গে এই অ্যাপ কীভাবে যুক্ত করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে।“
সে জন্য একটি কমিটি করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “ডিএমপি, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সফটওয়্যারের সঙ্গেও আমাদের সফটওয়্যার যুক্ত করতে হবে যেন কোনো সমস্যা না হয়। এই কাজগুলো করতেই দেরি হচ্ছে,। আমরা তো অ্যাপ তৈরি করেছিলাম আরও আগেই।”