ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতাকর্মীর বাসাবাড়িতে হামলা, পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে।
Published : 05 Aug 2024, 11:40 PM
প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বিভিন্ন স্থানে হত্যা, বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মীসহ বিশিষ্টজনরা। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
তবে নতুন পরিবর্তনকে বিজয় হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
কোটা আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন সহিংস রূপ পাওয়ার পর তা সরকার পতনের আন্দোলনের রূপ পায়। এই আন্দোলনের মধ্যে সারা দেশে সহিংসতা প্রাণ যায় অন্তত ৩০০ মানুষের।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সামরিক হেলিকপ্টারে করে তিনি পৌঁছান প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। ইতোমধ্যে তিনি যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বলে খবর এসেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে।
সোমবারের দুপুরের পর থেকে গণভবন, সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় লুটপাট। এসময় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি, আওয়ামী লীগের একাধিক কার্যালয়, দেশের বিভিন্ন থানাসহ একাধিক স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতাকর্মীর বাসাবাড়িতে হামলা, পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে।
এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাব্বির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, বাংলাদেশের সামনে আইনগত জটিলতার একটি সংকটকাল চলছে।
তিনি বলছেন, যে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে আলোচনা চলছে তা সংবিধানে নাই। ফলে এটি কিভাবে সামনে এগোবে, তা দেখতে হবে।
“সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভাও আর নেই। কিন্তু সংসদ ভেঙে যায়নি, এখনো আছে। রাষ্ট্রপতির হাতে এখন যেটা আছে, তা হলো- বিরোধী দলগুলো একমত হলে, তিনি ইচ্ছে করলে সংসদের মধ্য থেকে অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করতে পারেন। সংসদ সদস্যরা সেখানে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারেন।"
এটি যে প্রায় অসম্ভব তা তুলে ধরে অধ্যাপক সাব্বির বলেন, "সংসদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখন এটা অন্যরা মানবে কিনা সেটা একটা বিষয়। আবার এ পরিস্থিতিতে ডাকলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা যাবেন কিনা, তাও বলা কঠিন। সমাধানের জন্য আলোচনায় বসতে হবে।"
এসব প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, "এরকম কিছু করতে হলে সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে। এর বাইরে আমার কিছু জানা নেই।
"প্রেসিডেন্ট চাইলে অর্ডিনেন্স জারির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুর্নবহাল করতে পারেন। সেক্ষেত্রে এখন সংসদে কোরামের ক্রাইসিস হতে পারে। না হলে পরের সংসদ দেখবে, নির্বাচন হবে। এটা একটা ক্রাইসিস পিরিয়ড।"
দেশজুড়ে চলা নৈরাজ্যের বিষয়ে অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, "সাময়িক দায়িত্ব এখন সেনাবাহিনীর, তাদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। ভবনে আগুন, লুটপাট, ভাঙচুর হচ্ছে, সংসদ ভবনও বাদ যাচ্ছে না এগুলো ঠিক হলো না, কাম্য না। কারফিউ কার্যকর থাকলে ভালো হতো। এসব যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।"
চলমান নৈরাজ্যে মানবাধিকার কর্মী খুশী কবীর 'অত্যন্ত ক্ষুব্দ, মর্মাহত ও ভীত'।
তিনি বলেছেন, সেনাপ্রধান তার উপর আস্থা রাখতে বললেও চলমান পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
"শুধু ঢাকার কিছু জায়গায় তারা আছে। বাকিটা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই বা নিয়ন্ত্রণ করছে না। তাহলে তাদের রাখার দরকার কি? দেশজুড়ে একটা ভয়াবহ অবস্থা চলছে।"
পরিচিতদের উদাহরণ টেনে খুশী কবীর বলেন, “দুইজন মেয়েকে রাস্তায় শাখা-সিঁদুর খুলতে বলেছে, না হলে নাকি বারোটা বাজবে। এভাবে মন্দিরে, হিন্দুদের ওপর হামলা করা হচ্ছে।”
দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার তাগিদ দিয়ে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, “আর্মি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে না কেন? ভাঙচুর, লুটতারাজ করছে। সংসদ ভবনে ঢুকে যা ইচ্ছা করছে। এটা কোন ধরনের অবস্থা? নিরাপত্তা দিতে সেনাবাহিনী ব্যর্থ হচ্ছে কেন?”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল আলীম মনে করেন, বড় দুর্ঘটনা এড়াতে এখনই সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলা রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খুব দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে এবং সরকার প্রধানকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে আশ্বস্ত করতে হবে।
আব্দুল আলীম বলেন, “যখন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তখনই নিরাপত্তার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। আমরা সেটি নিতে পারিনি। কারফিউ যেটা ছিল, সেটা শক্ত হাতে কন্ট্রোল করা দরকার ছিল। এছাড়া তো অপশন নেই। কিন্তু কোথাও সেনা নেই।”
প্রত্যেক মানুষকে দেশের কথা চিন্তা করে শান্ত থাকা এবং লুটপাট-অগ্নিসংযোগ বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্ম নতুন স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে। এই বিজয় যাতে বেহাত হয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ তার।
“স্বৈরাচারের পতন হলো। এখন আমরা আর এই দেশে কোনো স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদী সরকার চাই না। এই দেশের মানুষ রক্তশোষণকারী মানুষের পরাজয় হল। তিনি বিতাড়িত হলেন। এই বিজয়ের ফসল যেন আমাদের সাধারণ মানুষ পায়, এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।”
নতুন সরকার যেন কোনো পক্ষের স্বার্থ রক্ষা না করে মানুষের কল্যাণে এবং অধিকার রক্ষায় কাজ করে সে আহ্বান জানান বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, “এই নিউ লিবারেশনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়, সেটিকে কোনোভাবে ছিনতাই হতে দেওয়া যাবে না। অন্যায়, অবিচার অপকর্ম, দুর্নীতি দুর্বত্তায়ন, খুনাখুনি এসবের অবসান হয়ে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাক, সেই আহ্বানই রইল।”
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, এই পরিবর্তনের কৃতিত্ব ছাত্রদের; তবে তারা একা দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে না। ভবিষ্যৎ গড়ার প্রধান বাহিনী হবে তারা।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে “পৃথিবীর সব দেশে আন্দোলনের একটা সুতিকাগার থাকে, আন্দোলনের একটা অগ্রবাহিনী থাকে। ছাত্ররা সেই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সেটা বৈরিতাপূর্ণ হয়েছিল, এটার অবসান দরকার। ভারতের এখানে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।”
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তিকালীন সরকার, জাতীয় সরকার, যাইই বলা হোক তা নির্ধারণ করবে আন্দোলনকারীরা।
“কিন্তু আমি বলব, রাজনৈতিক এজেন্ডার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের বিচার যেটা সেনাপ্রধান বলেছে সেটা যেন প্রতিহত না হয়।”
দীর্ঘমেয়াদি এজেন্ডার অর্থনৈতিক বিষয়ে এ অধ্যাপক বলেন, “বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়ী দেশ। এটাকে নষ্ট করেছে এই নিউ লিবারেল পলিসি। এটা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসব সেটা ভাবতে হবে। এটা একা বাংলাদেশের কাজ নয়, তবে আমাদের কাজ করতে হবে।”