“এখনো বাবা-মায়েরা ভালো ছেলে পেলে, চাকরীজীবী ছেলে পেলে, বিদেশে থাকে এমন ছেলে পেলে তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে দেয়।”
Published : 05 Oct 2023, 05:01 PM
আইনে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক দেশের ২৭টি জেলায় বড় আকারের গবেষণা করে জানতে পেরেছে, প্রতি দুটি মেয়ের একটিতেই কনের বয়স থাকে আইনে নির্ধারিত সর্বনিম্ন সীমা ১৮ এর নিচে।
এসব জেলার প্রবণতা দেখে সংস্থাটির অনুমান, সারা দেশে শতকরা ৬০ জন মেয়েই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে।
পাঁচ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
‘চাইল্ড ম্যারেজ: ট্রেন্ডস অ্যান্ড কজেস' শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাল্যবিয়ের প্রবণতা ও কারণ জানতে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি ২৭ টি জেলার প্রায় ৫০ হাজার খানায় এই জরিপ চালানো হয়েছে।
‘বর্ন টু বি অ্যা ব্রাইড, চাইল্ড ম্যারেজ: ট্রেন্ডস অ্যান্ড কজেস' শীর্ষক এই গবেষণাটি করতে ‘নন-প্রবাবিলিটি পারপাসিভ স্যাম্পলিং’ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীদের বেছে নেওয়া হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।
তথ্য অনুযায়ী, এসব জেলায় ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়।
৫৬ শতাংশ বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের বিয়ে হয়েছে এসএসসি পাসের আগেই। বাল্য বিয়ের শিকার মেয়েদের ৬ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে নিষিদ্ধ।
আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে তিনি অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে অনধিক এক মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তির কথাও বলা আছে।
বাবা, মা বা অভিভাবকরাও আছেন শাস্তির আওতায়। বাল্য বিয়ে করালে তাদের সর্বোচ্চ দুই বছর ও কমপক্ষে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। যে ব্যক্তি বাল্যবিয়ে পরিচালনা করবেন, তারও একই সাজার কথা বলা আছে।
অবশ্য বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং অভিভাবকের সম্মতিতে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিয়ের সুযোগ আছে।
মূল কারণ ‘যোগ্যপাত্র, দারিদ্র্য ও ‘যৌতুক কম চাওয়া’
গবেষণায় মেয়েদের আইনে নির্ধারিত বয়সের আগে বিয়ে দেওয়ার পেছনে অভিভাবকরা ৪৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই ‘যোগ্য পাত্র পাওয়ার’ কথা জানিয়েছেন।
অভিভাবকদের কাছে যোগ্য পাত্রের মানদণ্ড কী, সে বিষয়ে অবশ্য প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। তবে অনুষ্ঠানে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সালেহা বিনতে সিরাজ বলেছেন, “এখনো বাবা-মায়েরা ভালো ছেলে পেলে, চাকরীজীবী ছেলে পেলে, বিদেশে থাকে এমন ছেলে পেলে তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে দেয়।”
গবেষণায় দেখা যায়, বাল্য বিয়ের দ্বিতীয় শীর্ষ কারণ হিসেবে দারিদ্র্যের কথা বলেছেন শতকরা ১৮ শতাংশ অভিভাবক।
পাত্রপক্ষের যৌতুক না চাওয়া বা কম চাওয়ার কারণে মেয়েকে কিশোরী বয়সে বিয়ে দিয়েছে ১০ শতাংশ পরিবার।
এছাড়া ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়ে পড়ালেখায় ভালো না হওয়ার এবং এবং অন্যান্য কারণের কথা বলেছে ১৫ শতাংশ পরিবার।
বাল্যবিয়ে সবচেয়ে বেশি পিরোজপুরে
কিছু কিছু জেলায় বাল্যবিয়ের হার সারা দেশের সামগ্রিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।
পিরোজপুর বাল্যবিয়ের হার পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ এই জেলায় প্রতি ১০০টি মেয়ের ৭২ জনেরই বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে।
এর পরে আছে যথাক্রমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৬৫ দশমিক ২ শতাংশ), নওগাঁ (৬৫ দশমিক), ঠাকুরগাঁও (৬২ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং জয়পুরহাট (৬১ দশমিক ৪ শতাংশ) জেলা ।
২০৪১ সালের মধ্যে শূন্যে নামাতে চায় সরকার
অনুষ্ঠানে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সালেহা বিনতে সিরাজ বলেন, “এসডিজি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় বাল্যবিবাহ। আমরা ঠিক করেছি আমরা ২০৪১ সাল নাগাদ বাল্যবিয়ে দূর করব।”
“এই প্রথা একদিনে শেষ করতে পারব না” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য সরকার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। যেমন, যে ঘরে কিশোরী মেয়ে আছে, সেই মাকে চাল দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা দিচ্ছি। শর্ত হলো- মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে হবে, বিয়ে দেয়া যাবে না।”
‘ছেলেদের বোঝান’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারপারসন বেগম মেহের আফরোজ চুমকিও। তিনি গবেষক দলকে ছেলেদেরকে নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, “যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের নিয়ে স্টাডি হচ্ছে। যেই ছেলেগুলো বিয়ে করছে ছোটদের ওদের নিয়ে স্টাডি করেন। স্টাডিগুলো আধুনিক করেন, স্মার্ট করেন। ওদেরকে (ছেলেদেরকে) বোঝান যে, অল্প বয়সী কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে প্রথমে ভালো লাগবে। কিন্তু কিছুদিন পর বউকে পছন্দ হবে না। অনেক দিক দিয়ে মেয়েটা অনভিজ্ঞ থাকবে, সে মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল নাকি তখন একটা বাদ দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবেন?”
এই অভ্যাসও অনেকের আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বিদেশ থেকে ছেলেরা এসেই অল্পবয়সী মেয়ে খোঁজ করে। এই অভ্যাস বন্ধ হওয়া দরকার।”
বিনা মূল্যে বই ও বৃত্তির কারণে স্কুল পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি হলেও মেয়েরা এরপর ঝরে পড়তে শুরু করে জানিয়ে আক্ষেপও করেন এই সংসদ সদস্য।
এর পেছনে মেয়েদেরও ভূমিকা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এমন অনেক কেসও আছে, যেখানে ফেইসবুক থেকে কাউকে পছন্দ করার পর মেয়েটাই বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে গেছে।
“গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড-এর কনসেপ্ট এদিকে (অঞ্চলে) সেভাবে নাই। তখন বাবা-মা মনে করেন, এখন বিয়ে ছাড়া গতি নাই। আর বিয়ে না দিলে মেয়ে তো পালিয়ে যাবে। এ রকম মূল জায়গায় হাত দিতে হবে আমাদের।”
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী, জাতিসংঘ, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।
ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির (সেলপ) প্রধান শাশ্বতী বিপ্লব ।
এতে জানানো হয়, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসাবে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা কিশোরীদের নিয়ে গ্রামভিত্তিক ‘স্বপ্নসারথি’ নামে একটি দল গঠন করেছে ব্র্যাকের সেলপ।