মৌচাকের সড়কদ্বীপে অযত্ন-অবহেলায় শহীদের সমাধি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রামপুরায় রাস্তায় নেমে জীবন দেন ফারুক ইকবাল।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2023, 07:26 AM
Updated : 25 March 2023, 07:26 AM

রাজধানীর অতি ব্যস্ত মৌচাক মোড়ের সড়কদ্বীপে হাজারো যানবাহন আর পথচারীর ভিড়ে চোখে পড়ে একটি স্থাপনা। সেটি যে দুই শহীদের সমাধিসৌধ, তা জানেন না অনেকেই।

দিনটি ছিল ৩ মার্চ, পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে সেদিন ঢাকার রামপুরায় যখন ছাত্র-জনতার মিছিল চলছে, তখন উত্তপ্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে চলল গুলি, শহীদ হলেন তরুণ ছাত্র ফারুক ইকবাল।

কলেজপড়ুয়া ছাত্রলীগ নেতা ফারুকের রক্তাক্ত মরদেহ সেসময় মৌচাক মোড়ে সমাহিত করা হয়; ৩৭ বছর পর ২০০৮ সালে সেখানে সমাধিসৌধ নির্মিত হলেও দীর্ঘদিন ধরে সেটি পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।

মৌচাকের পাশেই আবুজর গিফারী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন ফারুক। ছাত্রলীগ ও কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রাস্তায় নেমে জীবন দেন ফারুক। স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে গোড়ার দিকের এই শহীদকে ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ’ বলে থাকেন অনেকে, তার সমাধির গায়েও সেটি লেখা হয়েছে। অবশ্য তার আগেও মার্চ মাসে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায় সেই সময়ের সংবাদমাধ্যমের খবরে।

মৌচাক মোড়ে একই জায়গায় আরও এক শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে, তার নাম মো. তসলিম। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা তসলিম যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ১৭ ডিসেম্বর নিহত হন। সিদ্ধেশ্বরী বালক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

২০০৮ সালে এখানে সমাধিসৌধ নির্মাণ করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। তবে সেটি দেখভালের জন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সমাধির পাশে রিকশা ও মোটরসাইকেল রাখার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ হকারও বসেন। বেশিরভাগ সময় ধুলোয় ঢাকা থাকে বীর শহীদদের সমাধি।

এ ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সমাধি স্থানটিতে মাদকাসক্তদের অবাধ বিচরণ রয়েছে বলে শুনেছি। কারণ সমাধিটিতে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। এটি সংরক্ষণ করার দায়িত্ব তো সিটি করপোরেশনের। তারা সেটি ঠিকমতো করছে না।”

শহীদ ফারুকের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরুর পর ৩ মার্চ কারফিউ ভেঙে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আর্মির গুলিতে মারা যান ফারুক। এজন্য তাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ বলা হয়।”

সমাধি সৌধের সংস্কার কাজের কথা তুলে ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মামুন রশিদ শুভ্র বলেন, “এই স্মৃতিস্তম্ভটির কিছু সংস্কার কাজ করা হয়েছে। কিছু জায়গায় আমরা টাইলস লাগিয়েছি। তবে এখানে সীমানা প্রাচীর দেওয়া সম্ভব হয়নি। সিটি করপোরেশন থেকে কোনো লোকও নিয়োগ দেওয়া হয়নি এটি দেখভাল করার জন্য। যার জন্য এখানে ভাসমান হকার বসে।

“তবে আমরা নিজেদের মতে করে পাশের মার্কেটের নিরাপত্তা প্রহরীকে বলে রেখেছি, এই সমাধির উপর যেন কেউ গাড়ি পার্কিং না করে, হাঁটাচলা না করে।”

দিবসকেন্দ্রিক স্মরণ

মৌচাক থেকে একটু ভেতরে গেলে আবুজর গিফারী কলেজ। ১৯৭১ সালে এই কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন ফারুক। কলেজটির উল্টো দিকে স্থানীয়রা ফারুক ইকবাল স্মরণে একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে সেটি এমপিওভুক্ত হয়। আবুজর গিফারী কলেজ ও স্কুলেও ফারুক ইকবালকে নিয়ে প্রয়াণ দিবস ছাড়া ভিন্ন কোনো আয়োজন হয় না।

শহীদ ফারুক ইকবাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীদের ফারুক ইকবাল সম্পর্কে জানাতে চেষ্টা করি। এর জন্য আমাদের স্কুল ডায়েরিতে শহীদ ফারুক ইকবালের জীবনবৃত্তান্ত রয়েছে।”

ফারুক ইকবালকে নিয়ে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান কিংবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় কিনা, জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, “মূলত দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানই করা হয়। ৩ মার্চ আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এছাড়া দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।”

ফারুক ইকবালের সমাধি সৌধে গত ৩ মার্চে দেওয়া ফুলের অংশবিশেষ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সমাধিসৌধের ঠিক মাথার উপর দিয়ে রামপুরা-মালিবাগ উড়াল সড়ক চলে যাওয়ায় খানিকটা আড়ালেই পড়ে থাকে সেটি।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কেন নাম নেই, প্রশ্ন পরিবারের

মালিবাগের গুলবাগে ২৯৪/১ নম্বর বাড়ির গেটে যেতেই চোখে পড়ল নেমপ্লেট, লেখা আছে শহীদ ফারুক ইকবাল ভিলা। বাড়িটির  পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে পাওয়া গেল ফারুক ইকবালের ছোট ভাই মোশতাক আহমেদকে।

আলাপের ফাঁকে বললেন, “শহীদ ফারুক ইকবালকে সবাই মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রথম শহীদ’ বলে স্বীকৃতি দেয়। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে এখনও তার নাম ওঠেনি।”

এরপর মোবাইলে কথা হয় ফারুক ইকবালের বড় ভাই এএনএম জুলফিকার হারুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমরা পরিবার থেকে কখনও তালিকায় নাম তোলার জন্য আবেদন করিনি। এরশাদের আমলে একবার সরকার থেকে একটা ফরম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার আব্বা আবেদন করতে রাজি হননি।

“আব্বা তখন বলতেন, ‘আমার ছেলে শহীদ হইছে, এটাই সম্মানের। এর বিনিময়ে সরকার থেকে আমরা কোনো সুবিধা নেব না’। তখন আর আবেদন করা হয়নি। এরপর সরকার থেকেও আর আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।”

তবে জুলফিকার হারুন ও মোশতাক আহমেদ দুজনেই এখন চান তার শহীদ ভাইয়ের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকুক।

জানতে চাইলে শাহরিয়ার কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক শহীদের নামই এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে শহীদের তালিকায় ফারুক ইকবালের নাম রয়েছে।”

লেখক ও গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা আছে। যার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা চূড়ান্ত করছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। ফারুক ইকবালের নাম সে অর্থে কিংবা সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী হয়ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসেনি।”

সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার ক্ষেত্রে যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, সেখানে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বা প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের বিবেচনা করা হয়েছে।

তবে নাম তালিকায় থাকুক আর না থাকুক, ইতিহাসের তালিকায় ফারুক ইকবালের নাম ‘চির অমর’ হয়েই থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মুনতাসীর মামুন বলেন, “সরকারি তালিকায় নাম থাকলে হয়ত কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবে তার পরিবার। কিন্তু তালিকায় নাম না থাকলেও ইতিহাস থেকে ফারুক ইকবালের নাম মুছে ফেলা যাবে না।”

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ফারুক ইকবালের নাম আছে কি নেই, সেটি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আর তাদের পরিবার থেকেও কোনো আবেদন করা হয়েছিল কিনা সেটিও দেখতে হবে।”

ফারুক ইকবালের ভাই মোশতাক আহমেদ বলেন, “আমার ভাই তো মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে। তার নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তার বীরত্বগাথা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের।

“সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তার পাশে বড় করে ইতিহাসটিও লেখা থাকা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ বলা হবে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম থাকবে না। সেটা নিয়ে পরের প্রজন্ম তো বিভ্রান্তও হতে পারে। এজন্য সরকার থেকে তালিকায় নাম তোলার উদ্যোগ নেওয়া হোক। যথাযথ সম্মানটুকু দেওয়া হোক, এটাই চাই।”

ফারুক ইকবালের শহীদ হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তার বড় ভাই জুলফিকার হারুন বলেন, সেদিন ফারুকের জানাজায় ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, বীরবিক্রম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন।

“১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কবরটি সংরক্ষণ করা হয়। তৎকালীন মেয়র হানিফ ভাই কবরটিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।”