জেলা ও আশপাশের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সড়ক ও মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দূরে থাকা স্বজনরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।
Published : 22 Aug 2024, 10:23 PM
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায় আটকে পড়া বন্ধুর পরিবারের খোঁজ পেতে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জাহান ই গুলশান।
বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টার দিকে ওই পোস্টে তিনি লেখেন, “জরুরি উদ্ধারকারী চাই। ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রাইমারি স্কুলের পাশে পানিবন্দি আমার বন্ধুর পরিবার। উদ্ধারকারীরা আসুন প্লিজ।”
বন্যা কবলিতদের পরিস্থিতি জানতে ফোন করা হলে জাহান ই গুলশান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বন্ধুর ষাটোর্ধ্ব মা ছাগলনাইয়ার গ্রামের বাড়িতে থাকেন। পরিবারের বাকি সদস্যরা থাকেন ঢাকায়।
“কাজের লোকদের সঙ্গে তিনি ওই বাড়িতে থাকেন। সেখানে ওদের বাড়িটা দোতলা, পানি এত দ্রুত বাড়বে তারা বুঝতে পারেনি। সবশেষ যখন কথা হয় তখন পানি দোতলা ছুঁয়েছে। আমি অনেকভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, এখনও করছি। কিন্তু কোনো খবর এখনও পাইনি।”
সরকারি এ কর্মকর্তার মত ফেনীর ফাজিলপুরে বন্যায় আটকে পড়া স্বজনদের উদ্ধারে আহ্বান জানিয়েছেন সংবাদকর্মী আনোয়ার হোসেন।
বৃহস্পতিবার তিনি ফেইসবুকে লেখেন, “বড় বোনের মেয়েটা ১ বছরের বাচ্চা নিয়ে ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেও পানি উঠতেছে। শেষ কথা, মামা বাঁচান আমার বাচ্চাটাকে। বোনদের সাথে যোগাযোগ নাই। ভাই, ভাবি, ভাতিজা ভাতিজি কেমন আছে জানি না।
”হেলিকপ্টার ছাড়া এই মুহূর্তে বিকল্প কি আছে জানি না। বিকাল পর্যন্ত বৃষ্টি হলে, এদের লাশ ছুয়ে শোক করারও উপায় থাকবে না। হেলিকপ্টার, সরকারের প্রশিক্ষিত বাহিনী, দয়া করে এখনি উদ্ধার করেন। মৃত্যুর পর, ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ, ত্রাণ দেওয়া এসব করার মানুষও পাবেন না। এই কষ্ট আর নিতে পারছি না। আল্লাহ তুমি রহম করো।”
সেখানে একটি মোবাইল নম্বর দিয়েছেন তিনি। তবে ওই মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
সবশেষ পরিস্থিতি জানতে যোগাযোগ করা হলে আনোয়ার বলেন তিনি নিজেও দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও তার ভাগ্নির সঙ্গে আর কথা বলতে পারেননি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের বাড়িটা ফেনী শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে। ওই গ্রামে পাকা বাড়ির সংখ্যাও কম। এজন্যই আশঙ্কা হচ্ছে বেশি। এখনও পর্যন্ত তাদের কোনো সন্ধান পাইনি। তাদের উদ্ধার করা হয়েছে কি না তাও জানি না।”
শুধু এ দুজন নয়, তাদের মত ফেনীর বাইরে থাকা অসংখ্য ব্যক্তি তাদের স্বজনদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বন্যায় আটকে পড়া স্বজনদের উদ্ধার করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। সেখানে প্রকাশ পেয়েছে স্বজনদের উদ্ধারে তাদের আকুতি।
ভারি বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা ঢলে ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পানিতে সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎবিহীন পরিস্থিতিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় মোবাইলেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছেন স্বজনরা। ফলে বন্যায় আটকে পড়া স্বজনদের উদ্ধারে বিকল্প সব উপায়ই খুঁজছেন তারা। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহায়তা চেয়েছেন।
গত দুই দিনে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে পড়ে ফেনীসহ আশপাশের এলাকা। ভারত থেকে আসা ঢল আর ভারি বর্ষণে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। বিশেষ করে পরশুরাম, ফুলগাজী এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
ওইসব এলাকায় অনেক বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানি দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় সেসব এলাকায় আটকে পড়েছেন অনেক মানুষ। শুরুর দিকে মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারলেও এক পর্যায়ে মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে যায়।
পরশুরাম উপজেলার উত্তর গুথুমা এলাকায় বন্যায় আটকে পড়া বোনকে উদ্ধার করতে ফেইসবুকে সহায়তা চেয়েছেন মাহতাব হোসেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি লেখেন, “গতকাল থেকে আমার বোনের পরিবারের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। কেউ কি আছেন-সেখানে বসবাস করেন, কোনো তথ্য দিতে পারবেন?”
পরে মাহতাব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেখানে তার বোনের বাড়ি। বুধবার সকাল ৯টার দিকে সবশেষ কথা হয়েছিল। তখন তারা জানিয়েছে পানি দ্রুত বাড়ছে।
“আমার বোন, দুলাভাই তাদের দুটো বাচ্চা সেখানে। ওই সময় কেবল পানি বাড়তে শুরু করেছে। তাদের বাড়ি পাকা, কিন্তু একতলা। যেভাবে পানি বাড়ছে, যদি ছাদে পানি উঠে তাহলে তো সর্বনাশ। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি ততক্ষণ চিন্তামুক্ত হতে পারছি না।”
নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে ফেনীর পরশুরামে বেড়াতে গিয়ে বন্যায় আটকে পড়েছেন আতিকুর রহমানের স্বজনরা। স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তিনিও ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।
সেখানে তিনি বলেছেন, “পরশুরাম উপজেলা শহর থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে, গ্রাম: পূর্ব অলকা, চৈতার বাজার থেকে একটু পশ্চিম দিকে গেলে তিন রাস্তার মোড়। সেখানে একই সঙ্গে ঘোষ বাড়ি, ভূঁইয়া বাড়ি ও ম্যানেজার বাড়ি। ম্যানেজার বাড়িতে আমার পরিবারের ৭ জন সদস্য বন্যার পানিতে আটকা পড়েছেন। কোনো সেচ্ছাসেবকের সম্ভব হলে তাদের উদ্ধার করুন।”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের স্বজনদের কোনো খোঁজ পাননি আতিকুর। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ সেখানে উদ্ধারকারী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। বেশির ভাগ নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
“নৌবাহিনীর একটা নম্বরে কথা বলতে পেরেছি। কল ধরে তিনি আমাকে বেশ কিছু মোবাইল নম্বর দিয়েছেন যারা বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করছেন। কিন্তু দিনভর চেষ্টা করেও সেসব নম্বরে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাই ঠিক জানি না তাদের কী হয়েছে, তারা কেমন আছেন।”
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূর উল্লাহ বলেন, পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পরে উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন তিনি।
“আমার সাধ্যমত সব সোর্স থেকে খোঁজখবর নিয়েছি গত দুইদিন। এখন কোনো সোর্স পাচ্ছি না। সব সোর্স বন্ধ। হার্ট ফেইল করবো মনে হচ্ছে। হয়তো স্বজনেরা সংগ্রাম করেও ভালো আছে। হয়তবা ভালো নাই। শুধু খোঁজ নিতে পারলে অস্থিরতা কাটাতে পারতাম। নিজ বাড়ি, গ্রাম, দুই বোনের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।”