‘সন্ত্রাসমুক্ত চট্টগ্রাম’ বনাম ‘স্বপ্নের মেগাসিটি’

সদ্য সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের সন্ত্রাসমুক্ত উন্নত চট্টগ্রাম গঠনের অঙ্গীকারের বিপরীতে আ জ ম নাছির উদ্দিন গড়তে চান জলাবদ্ধতামুক্ত স্বপ্নের মেগাসিটি।

মিন্টু চৌধুরীও মিঠুন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2015, 05:49 PM
Updated : 23 April 2015, 06:00 PM

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) নির্বাচনের প্রচারণার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পাঁচ দিন আগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নাছির ও চার দিন আগে বিএনপি সমর্থিত মনজুর তাদের ইশতেহার দেন।

দুজনের ইশতেহারে প্রধান স্থান দখল করে আছে নগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা জলাবদ্ধতা। এ সঙ্কট নিরসনে ১৮ লাখ ভোটারের কাছে দুই প্রার্থীর অঙ্গীকারগুলোও কাছাকাছি।

প্রায় ৬০ লাখ জনসংখ্যার বন্দর নগরীতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন থেকে মনজুর এবং চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি থেকে নাছির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এক অর্থে তা বিএনপি-আওয়ামী লীগেরই লড়াই।

আগামী ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আরও ১০ মেয়র প্রার্থী থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাছির-মনজুরের মধ্যেই হবে বলে ভোটাররা মনে করেন, প্রচারেও তারা এগিয়ে।    

দুই ইশতেহার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একবার করপোরেশন পরিচালনায় অভিজ্ঞ মনজুর ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা’ নিশ্চিত করে ভবিষ্যতে বাস্তবতার কঠিন পথে হাঁটতে চান সতর্ক পদক্ষেপে। 

বিপরীতে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নাছির মেগাসিটি গড়তে ‘ফ্রেমবন্দি দফায়’ সীমাবদ্ধ না থেকে টেসকই ‍উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার লক্ষ্য ঠিক করেছেন।

নাছিরের ইশতেহারে আছে সদ্য বিদায়ী মেয়র মনজুরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘ব্যর্থতার’ সমালোচনা। অন্যদিকে মনজুর ইশতেহারে নিজেকে এ ইস্যুতে সিংহভাগ সফল দাবি করে ‘উন্নয়নের’ ধারাবাহিকতা রক্ষায় বাকি কাজ শেষ করার সুযোগ চেয়েছেন।

নগরবাসীর নিরাপদ ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ ও দলবাজমুক্ত এবং নিরাপদ খাবারের আগার নগরী গড়তে চান মনজুর। আর নাছির মনে করেন কেবল তিনি নির্বাচিত হলেই চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকারের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন হবে।

ইশতেহার ঘোষণায় মনজুর আলম বলেন, “চট্টগ্রাম শহর কি আগামী দিনে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দলবাজের অভয়ারণ্য হবে, না কি নিরাপদ সন্ত্রাসমুক্ত জনপদ হবে এই একটি সিদ্ধান্ত সচেতন ভোটারদের নিতে হবে।”

সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ এসব শব্দ কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কাউকে মিন করে বলিনি। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা মানুষের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন, সেজন্য বলেছি।”

আগের দিন ইশতেহার ঘোষণা করে নাছির বলেন, “এখনও চট্টগ্রামই হতে পারে বিশ্বের অন্যান্য এক আদর্শ গ্রিন মেগাসিটি। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন করা যায়।”

এক কোটির কম জনসংখ্যা নিয়ে মেগাসিটি বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নাছির বলেন, “এটা আমার স্বপ্ন, একটা টার্গেট। কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল হলে নদীর দুই পাড়ে শহর হবে। তখন জনসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে।”

জলাবদ্ধতা সমাধানে এক

বন্দর নগরীর দীর্ঘদিনের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা ঘিরেই মূলত আবর্তিত হয় সিটি নির্বাচনের যুদ্ধ। এবারও প্রধান দুই মেয়র প্রার্থীর ইশতেহারে তাই প্রাধান্য পেয়েছে এই ইস্যু।

ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে এম মনজুর আলম

সমাধান হিসেবে দুই প্রার্থীর ইশতেহারেই ঘুরে ফিরে এসেছে খালের মুখে স্লুইস গেইট নির্মাণ, কর্ণফুলীর ড্রেজিং, একনেকে অনুমোদন পাওয়া নতুন খালটি খনন আর ১৯৯৫ এর ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান নবায়ন ও বাস্তবায়ন।

জলাবদ্ধতা থেকে ‘স্থায়ী মুক্তি’ দিতে চাওয়া নাছির খাল-নালা দখলমুক্ত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে চান। অথচ মনজুরের দাবি গত মেয়াদে দখলমুক্তির চেষ্টায় ৮০ শতাংশ সফল তিনি।

খালে জমে থাকা আর্বজনা অপসারণ ও তদারকিতে একটি বোর্ড গঠন করতে ইচ্ছুক নাছির। আর মনজুরের দাবি গত সাড়ে চার বছরে নিয়মিত খালে জমা মাটি-আর্বজনা অপসারণ করায় জলাবদ্ধতা এখন ‘জলজটে’ এসে ঠেকেছে।

ওয়াইফাই ও আয়বর্ধক প্রকল্প

করপোরেশনের কর ও বিল প্রদানে স্মার্ট কার্ড এবং নাগরিক সেবা প্রাপ্তিতে ওয়ানস্টপ সুবিধা দিতে আগ্রহী নাছির। পাশাপাশি পুরো নগরীকে আনতে চান ওয়াইফাই জোনের আওতায়।

বিপরীতে কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ওয়াইফাই জোনের আওতায় আনতে চান মনজুর। আর সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে খুলবেন অভিযোগ বক্স।

সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে আয় বর্ধক প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ায় মনজুরের কড়া সমালোচনা করে নাছির নির্বাচিত হলে আবার সিসিসির ওষুধ কারখানা চালুর ঘোষণা দিয়েছেন।

পাশাপাশি সিসিসির উদ্যোগে বাণিজ্যিক ভবন, কারখানা আর ব্যবসা করে আয় বাড়াতে চান নাছির।

আয় বাড়াতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের সামাজিক ব্যবসার আদলে বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চান বিএনপি সমর্থিত মনজুর।

বর্জ্য থেকে মনজুরের বিদ্যুৎ, নাছিরের গ্যাস

সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময়ে পরিচ্ছন্নতার জন্য দেশব্যাপী সুনাম ছিল চট্টগ্রাম নগরীর।

ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে আ জ ম নাছির উদ্দিন

গত পাঁচ বছরে মনজুরের মেয়াদকালে সেই সুনাম অনেকটাই হারিয়েছে নগরী। এজন্য ‍অবশ্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর অপ্রতুল লোকবলকেই দূষছেন মনজুর আলম।

ইশতেহারে নগরীকে বর্জ্য মুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণ এবং সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি আছে। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উপাদন প্রকল্প গ্রহণেরও অঙ্গীকার আছে।

অন্যদিকে নগরীকে বর্জ্যমুক্ত রাখতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ডাস্টবিন স্থাপন, সেন্ট্রাল সুয়ারেজ পাইপ লাইন স্থাপন এবং বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের প্ল্যান্ট স্থাপন করতে চান নাছির।

নির্বাচনের আগে ভোটারদের দেয়া প্রতিশ্রুতিতে নাছির কর্ণফুলী ও পাহাড় রক্ষা করে পরিবেশ বান্ধব নগরী গড়তে চান। মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন প্রকল্প, পার্ক স্থাপন, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, পাবলিক টয়লেট স্থাপন এবং হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়ে টেকসই উন্নয়ন করতে আগ্রহী নাছির।

অন্যদিকে ভোটারদের দেয়া ৫৪ দফার প্রতিশ্রুতিতে নতুন নগর ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ করা, হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়ে তা আদায়ের কৌশল নির্ধারণ, নির্মাণাধীন বাকলিয়া স্টেডিয়ামের কাজ শেষ করা, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের উন্নয়ন, বাস ও ‍ট্রাক টার্মিনাল স্থাপন, বাস সার্ভিস আবার চালু এবং পোশাক শ্রমিকদের জন্য আবাসন প্রকল্প করতে চান মনজুর।