অভিজিৎ হত্যায় ফারাবী গ্রেপ্তার

লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় সেই শাফিউর রহমান ফারাবীকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে, যিনি এর আগে ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর ফেইসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2015, 06:47 AM
Updated : 16 Feb 2021, 12:04 PM

উগ্রবাদীদের পক্ষে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফারাবী বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইট ‘রকমারি ডটকম’ থেকে অভিজিৎ রায়ের বই সরাতেও হুমকি দিয়েছিলেন।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “উগ্রপন্থি ব্লগার ফারাবীই লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন। সোমবার সকালে ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করলে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।”

ফারাবীকে বিকালে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে তুলে দেয় র‌্যাব। অভিজিৎ হত্যামামলাটি ডিবি তদন্ত করছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। হামলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বন্যার একটি আঙুল।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। তার খুনের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও প্রধান শিরোনাম হয়।

জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানায়।   

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহায়তার আগ্রহ দেখালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাতে সম্মতি দেওয়া হয়েছে বলে রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের জানান।

হত্যাকাণ্ডের পর ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ফারাবীর নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। তিনি অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন অভিযোগ করে তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আসা একটি কমেন্ট শেয়ার করা হয়।

একজনকে উদ্দেশ করে ওই কমেন্টে বলা হয়, “অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।”

দুপুরে র‌্যাব সদর দপ্তরে বাহিনীর মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, ৪-৫ বছর আগে ফারাবীর সঙ্গে অভিজিতের ফেইসবুকে যোগাযোগ হয়। কিন্তু বিপরীতমুখী আদর্শের কারণে অভিজিৎ দুই বছর আগে ফারাবীকে ‘ব্লক’ করে দেন।

“বিভিন্ন সময়ে ফারাবী ফেইসবুকে অভিজিতের পরিবারের সদস্যদের ছবি ও স্ট্যাটাস দিয়েছেন, যাতে দেশে এলে অভিজৎকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।”

তাছাড়া ফেইসবুকে ‘ফারাবী ব্লগ’ নামের একটি পৃষ্ঠায় তিনি ধর্মীয় উসকানিমূলক স্ট্যাটাসও দিতেন বলে মুফতি মাহমুদ জানান।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়ানোয় ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে ফারাবী। 

ওইবছর ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট এলাকা থেকে পুলিশ ফারাবীকে গ্রেপ্তার করে। ফেইসবুক ব্যবহার করে ইমামকে হত্যার হুমকি দেওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে জুন মাসে ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগও গঠন করে।

কিন্তু হাই কোর্টের জামিনে ২০১৩ সালের ২১ অগাস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যান ফারাবী। আর মুক্তি পেয়েই ‘নাস্তিকদের’ হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে তিনি ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন, যাতে বলা হয় “আমার দৃষ্টিতে নাস্তিকরা হচ্ছে পোকামাকড় আর পোকামাকড়দের মরে যাওয়াই ভাল।”

এদিকে অভিজিৎকে হত্যার পর ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে একাধিক টুইট করে এ হত্যাকাণ্ডকে ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করা হয়।

এর একটিতে বলা হয়, “আল্লাহু আকবর.. বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য। টার্গেট ইজ ডাউন..।” আর অন্যটিতে অভিজিৎ ও তার স্ত্রীর একটি ছবি শেয়ার করে বলা হয়, “ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ইসলামবিরোধী ব্লগার আমেরিকান বাঙালি অভিজিৎ রায়কে রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে।”

‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব বা অভিজিত হত্যায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে তাদের সন্দেহের তালিকায় যে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনও রয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তাদের কথায় তা স্পষ্ট।

হত্যাকাণ্ডের পরদিন শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ও জঙ্গিদের সন্দেহের কথা বলেন।

থানায় উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমার ছেলেকে হত্যার জন্য উগ্র জঙ্গিবাদীরাই দায়ী। এদের মদদ দিয়েছে জামায়াত।”

অজয় রায়ের করা ওই মামলাতেই ফারাবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান।

তিনি বলেন, “ফারাবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হলেও ২০১০ সালে হিজবুত তাহরীরে সক্রিয় হয়ে লেখাপড়া শেষ করেনি। নাশকতার অভিযোগে সে একমাস জেলও খেটেছিল।”

বিজ্ঞানমনস্ক অভিজিৎ লিখতেন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে অবিশ্বাসের দর্শন, ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’, ‘ভালবাসা কারে কয়’, স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা : বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান।