পেট্রোল বোমা মেরে ‘মানুষ হত্যাকারী’ এবং তাদের ‘হুকুমদাতাদের’ দ্রুত ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Published : 22 Feb 2015, 12:47 PM
রোববার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মত বিনিময়ে তিনি এ নির্দেশ দেন।
দেড় মাসের বেশি সময় ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধে নাশকতার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ অবস্থা থেকে দেশের মানুষকে ‘উদ্ধার করতেই হবে’।
“যারা এখন হাতে নাতে ধরা পড়েছে এদের বিচারটা দ্রুত করে ফেলা।... যারা এরসঙ্গে জড়িত- একটা হচ্ছে হুকুমদাতা যে তাদের নির্দেশে হচ্ছে। অর্থের জোগানদার কে তাদের বের করা, বোমাগুলি তৈরি করছে কে, বোমাগুলি সরবরাহ দিচ্ছে কে, মারছে কে? এদের প্রত্যেকটা স্তরেই বোধহয় বিচার খুব কঠিনভাবে হওয়া দরকার। কারণ এ অবস্থা চলতে পারে না।”
মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ চালিয়ে আসছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট, যার মধ্যে দফায় দফায় হরতালও থাকছে।
এই কর্মূসচিতে নাশকতা ও সহিংসতায় এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের অধিকাংশই মারা গেছেন পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে।
নাশকতার এসব ঘটনায় সারা দেশে অসংখ্য মামলা হয়েছে, যার মধ্যে অন্তত চারটি মামলায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে।
এসব ঘটনার বিচারের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে বলেও ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
বোমা হামলায় জড়িতদের ধরায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “তারা খুঁজে খুঁজে বের করছে, ধরছে। ধরার ফলে অনেক নাশকতা থেকে বাংলাদেশ বাঁচছে।
“কিন্তু তাদের বিচারটা দ্রুত হওয়া দরকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও দ্রুত শাস্তি হওয়া দরকার, যাতে আর যেন কেউ এভাবে করতে না পারে।”
পরবর্তীতে এ ধরনের নাশকতা রোধে ‘দ্রুত’ ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হয়েছিলাম যে, দেশের উন্নয়নটা কত বেশি দ্রুত করব। সেখানে প্রতিশোধমূলক মনোভাব নিয়ে কিন্তু আমরা তাকাইনি বলেই হয়ত অনেকে রেহাই পেয়ে গেছে, যার জন্য আজকে এই বাড়তে পেরেছে। আগামীতে কিন্তু সেটা করা যাবে। এর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা আমাদের নিতেই হবে।”
হরতাল-অবরোধের নামে আগুন-বোমায় মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারীদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সঙ্গেও তুলনা করেছেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমি তো মনে করি, ১৯৭১ সালে যারা আমাদের নারী-শিশুদের হত্যা করেছে, নারীদের ওপর অত্যাচার করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে; এখন যারা এই ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে, পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে-এদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। এরা একই লোক- একই ধরনের, একই মানসিকতা নিয়ে তারা করছে। কাজেই এদেরও বিচার হতে হবে।”
যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে জামায়াতের তাণ্ডব এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস আন্দোলনের পরেও ‘দক্ষতার’ সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও গত ছয় বছরে গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
“যেখানে বাংলাদেশকে আমরা উন্নয়নের রোল মডেলে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ একটা দৃষ্টান্ত। সারা বিশ্ব যখন আমাদের অনুসরণ করবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখে; সেই মুহূর্তে হঠাৎ গত ৬ জানুয়ারি থেকে পেট্রোল বোমা মেরে আবার মানুষ হত্যা করা।”
নাশকতা ঘটিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে ‘হেয়’ করা হচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অর্জন কী করছে সেটা আমি জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মান, সন্মান, মর্যাদা যে ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে নষ্ট করছে এবং বাংলাদেশকে যে আজকে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন নিয়ে আসা; এটা কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট খুব ভালভাবে করে দিয়েছে।”
‘পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা’ করে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশি-বিদেশি সমর্থন হারাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “এটা করে তাদের কী অর্জন হবে? তারা শুধু তারিখ দিয়ে যাচ্ছে যে, এই তারিখের মধ্যে সরকার ফেলে দেবে। এখন দেশি-বিদেশি কারো সমর্থন পাচ্ছে না। এতোদিন পরের মুখাপেক্ষী ছিল। ভাবছিল যে, অনেক কিছু হয়ে যাবে তাদের পক্ষে।
“কিন্তু যারা পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ মারে তাদের পক্ষে কেউ থাকে না। এটা বোধহয় এখন দেখতে পেয়ে আরো বেশি করে কীভাবে মানুষ হত্যা করা যায় সেজন্য পেট্রোল বোমা নয় গ্রেনেড মারার পরিকল্পনা করছে এবং বড় বড় নাশকতা করার।”
নাশকতাকারীদের দমন করে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। কাজেই সেই দায়িত্বটা আমরা পালন করব। বাংলাদেশের মাটিতে কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসীর স্থান যেন না হয়, বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে শান্তিপূর্ণ দেশ। সেভাবেই আমরা এই দেশকে গড়ে তুলতে চাই।”
যুদ্ধাপরাধের বিচার
কোনো ধরনের শিথিলতা না দেখিয়ে আইন অনুযায়ী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দ্রুত শেষ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “যারা এভাবে আমাদের মা-বোনদের হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েছে, পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে। কাজেই এদের বিচার যদি না হয়, এটা একটা কলঙ্ক হিসেবে আমাদের থাকবে।
“এদের বিচার হলে আমি মনে করি- জাতি অভিশাপমুক্ত হবে, দেশ অভিশাপমুক্ত হবে। আর অভিশাপমুক্ত হলেই দেশের আরো উন্নতি হতে পারবে। সে কারণেই এ বিচারটা দ্রুত হওয়াটা একান্তভাবে প্রয়োজন এবং সে বিচারের কাজ হচ্ছে।”
জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বার্থে বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনারও তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।