কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএ ভবনে তোবা গ্রুপের পোশাক শ্রমিকদের বেতন দেয়া হচ্ছিল বুধবার থেকে, কারখানায় অনশন চলার মধ্যে প্রথম দিনে তা নিতে এসেছিলেন ৫৫০ জন।
Published : 07 Aug 2014, 10:55 PM
বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনে দুপুর পর্যন্তও বেতন দিতে বিজিএমইএ ভবনে স্থাপিত পাঁচটি টেবিলে ভিড় ছিল না বললেই চলে। সকাল ১১টা পর্যন্ত বেতন নেন ৫০ জন। ওই সময়ে বাড্ডায় তোবা কারখানা ভবনে পুলিশের অভিযানের প্রস্তুতি চলছিল।
এর দুই ঘণ্টার মধ্যে তোবা কারখানায় ঢুকে পিটিয়ে অনশনকারীদের বের করে দেয় পুলিশ। তারপরই ভিড় বাড়তে থাকে বিজিএমইএতে। বিকালে টেবিলগুলোতে শ্রমিকদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ নেতারা জানান, তোবা গ্রুপের ১ হাজার ৪৫৮ জন শ্রমিকের মধ্যে ১ হাজার ৩০৫ জন এসে বেতন নিয়ে গেছেন।
অনশনস্থল থেকে উৎখাত হওয়ার পরই শ্রমিকরা কারওয়ান বাজারে এসে বেতন নিতে ভিড় করেন, যাদের অনেকের দেহে পুলিশের পিটুনির জখম দেখা গেছে। এক নারী শ্রমিককে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠাতে হয়।
বেতন নিতে আসা শ্রমিকদের অনেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। যে কয়েকজন কথা বলেছেন, তারা তুলে ধরেছেন তাদের অসহায়ত্বের কথা।
আছিয়া বেগম নামে এক শ্রমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামনে বাচ্চাদের পরীক্ষা। অনেকের কাছে টাকা ধার চাইছি, কেউ দেয় নাই।
“আজকে আমরা যার জন্য টাকা পাচ্ছি, সেই মিশু আপার (মোশরেফা মিশু) সঙ্গে গাদ্দারি করতেছি আমি জানি। কিন্তু তারপরও আমি টাকা নিতে আসছি আর কোনো উপায় নাই বলে।”
শুরু থেকেই আন্দোলনে ছিলেন তোবা গ্রুপের পাঁচ কারখানার একটি বুকশান গার্মেন্টের এই অপারেটর।
তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির মামলায় তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেন কারাগারে থাকার মধ্যে পাঁচ কারখানার এই দেড় হাজার শ্রমিকের বেতন বকেয়া পড়ে।
শ্রমিকরা তিন মাসের বেতন দাবিতে গত ২৮ জুলাই কারখানায় অনশনে বসে, এরপর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, গড়ে তোলা হয় তোবা গ্রুপ সংগ্রাম কমিটি, যার সমন্বয়কের দায়িত্ব নেন গার্মেন্ট শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু।
বিজিএমইএ দুই মাসের বেতনের বন্দোবস্ত করে তা নিতে বললেও অনশনরত শ্রমিকরা তা প্রত্যাখ্যান করে পুরো তিন মাসের পাওনাসহ পাঁচ দফা দাবিতে অনশন চালিয়ে যায়।
এরমধ্যেই পাওনা পরিশোধের প্রথম দিন বুধবার শ্রমিকদের তেমন সাড়া দেখা যায়নি। অনশনরত শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, তাদের কিছু সহকর্মীকে জোর করে ধরে নিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার পুলিশ অভিযান চালিয়ে অনশন উৎখাত এবং শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু ও জলি তালুকদারকে আটকের পর বিজিএমইএ ভবনে ভিড় বাড়তে থাকে।
শরীফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশের হামলা শুরু হওয়ার সময় পালিয়ে নিচে নামতে গিয়ে ভেঙে থাকা কাঁচের আঘাতে হাতে আঘাত পেয়েছি।”
কিভাবে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কয়েকজন নেতা একটি পিকআপে করে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।”
সকাল থেকেই বিজিএমইএ ভবনে সরকার সমর্থক বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের বেশ তৎপর দেখা গেছে।
এই সংগঠনগুলো বিজিএমইএ’র সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলেও তোবা কারখানায় অনশনে ছিল গার্মেন্ট শ্রমিক ফোরাম, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ ১৫টি সংগঠন।
মিশু গার্মেন্ট শ্রমিক ফোরাম এবং জলি গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা। তারা দুজনই সাবেক ছাত্র নেতা।
বিজিএমইএ ভবনের নিচতলায় যেখান থেকে শ্রমিকদের বেতন দেয়া হচ্ছিলে, সেখানে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিন তোবাকর্মী নাজমা, হ্যাপি ও তাসলিমা, যারা শুরু থেকে অনশনে ছিলেন।
তাসলিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ টিয়ার গ্যাস মারছে, খুব খারাপ লাগছিল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল।”
তোবা ফ্যাশনের ফোল্ডিংম্যান রাফেজা গত তিন দিন ধরে কারখানাতেই ছিলেন। পুলিশ বের করে দেয়ার পরে তিনি বেতন নিতে আসেন বিজিএমইএ ভবনে।
রাফেজা ক্ষোভের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিশু আপারে গুলি কইরা, গ্যাস ছাইড়া ছারখার কইরা দিসে। ওরা কারেন্ট, পানির লাইন সব কাইটা দিসে। কারখানার ভেতরে ঢুইকা সবাইরে মাইরধর কইরা বাইর কইরা দিসে।”
আরেক কর্মী আফরোজা বাম হাতে জখম নিয়ে বলেন, “কারখানা ফাঁকা কইরা দিসে। মিশু আপারেও নামায়া দিসে। আর কাজ করুম না, দেশে যামুগা।”
দুপুরে বেতন নিতে আসা বুকশান গার্মেন্টের অপারেটর হাওয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল পর্যন্ত কারখানায় ছিলাম। পুলিশ আসল, তারা কাউকে বের হতে দিচ্ছিল না। কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়ল, তখন ওদের সাথে আমিও বাইরে চলে আসি।
তোবা গ্রুপের ‘তায়েব ডিজাইন’ এর অপারেটর নাজমা বেগম সকাল এসে দুই মাসের বেতন হিসেবে ১৩ হাজার টাকা তুলে নেন।
নাজমাও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বুধবার সন্ধ্যায় কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।
বাড্ডার হোসেন মার্কেটের সাততলায় তোবা গ্রুপের একটি কারখানায় অনশন কর্মসূচি চলছিল। হোসেন মার্কেটের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ তলা পর্যন্ত তোবা গ্রুপের তিনটি কারখানা রয়েছে। এগুলো হলে তোবা টেক্সটাইল, তায়েব ডিডাইন ও মিতা ডিজাইন। আর মার্কেট সংলগ্ন ফুজি টাওয়ারে রয়েছে তোবা ফ্যাশনস ও বুকশান গার্মেন্টস।
পুলিশ কারখানা ভবন থেকে অনশনরত শ্রমিকদের বের করে দেয়ার পর দেশের সব পোশাক কারখানায় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডেকেছে তোবা গ্রুপ সংগ্রাম কমিটি।
তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের মামলায় সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে দুদিন আগে মুক্তি পান।
দেলোয়ারকে মুক্ত করার জন্যই মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন আটকে রেখেছিল বলে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ।
বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, দেলোয়ারের অনুপস্থিতিতে তারা শ্রমিকদের দুই মাসের বেতনের বন্দোবস্তু করেছিলেন।
শ্রমিকদের জুলাই মাসের বেতন ১০ অগাস্টের মধ্যে দিতে দেলোয়ারকে বলা হয়েছে বলে বিজিএমইএ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান মন্ত্রী শাজাহান খান ও প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। তা না হলে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।