চট্টগ্রামে হেফাজতি মাদ্রাসায় বোমার ‘কারখানা’, বিস্ফোরণ

চট্টগ্রাম নগরীর মধ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতা মুফতি ইজাহারুল ইসলাম নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের পর সেখানে অভিযান চালিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেডসহ বিস্ফোরক এবং অ্যাসিডের অনেকগুলো বোতল উদ্ধার করা হয়েছে।

উত্তম সেনগুপ্ত, চট্টগ্রাম অফিসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2013, 07:45 PM
Updated : 7 Oct 2013, 07:46 PM

সোমবার সকাল ১১টায় লালখান বাজারের ওই মাদ্রাসার একটি ছাত্রাবাসে বিস্ফোরণের পর তা নগরীজুড়ে আলোড়ন তোলে।

মুফতি ইজাহারসহ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে ল্যাপটপ বিস্ফোরণের কথা বললেও আহতদের নিয়ে লুকোচুরি বেশ সন্দেহের সৃষ্টি করে।

রাতে জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া নামে ওই মাদ্রাসা ঘিরে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানে তিনটি তাজা হ্যান্ড গ্রেনেড, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, পিকরিক অ্যাসিডের ১৮টি বোতল উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

বিস্ফোরণস্থল পরীক্ষা করে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দমকল বাহিনী আগুন নেভানোর পর ছাইয়ের নিচে বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে।

“আমরা নিশ্চিত এখানে বিস্ফোরক দ্রব্যের বড় মজুদ ছিল,” বলেন তিনি।

বোমা তৈরির সময় এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে মনে করেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) শহীদুল্লাহ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম সফরের কয়েকদিন আগেই হেফাজত নেতার মাদ্রাসায় এই ধরনের ‘কারখানা’ পাওয়া গেল, যে সংগঠনটি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

বিস্ফোরণের সময় মাদ্রাসায় ছিলেন মুফতি ইজাহার। রাতে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে অভিযানের আগেও সেখানে তার অবস্থানের কথা জানিয়েছিল পুলিশ।

কিন্তু অভিযানের সময় মুফতি ইজাহার কিংবা তার ছেলে হারুন ইজাহার- কাউকেই পায়নি পুলিশ। আটক করেছে মাদ্রাসার তিন শিক্ষকসহ পাঁচজনকে।

আটকরা হলেন- মাদ্রাসার তিন শিক্ষক তাফসির আহমদ, আবদুল মান্নান ও মো. ইসহাক, মাদ্রাসার ডাইনিং সুপার মুনির হোসেন এবং শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান।

এছাড়া বিস্ফোরণে আহত চারজনকে হাসপাতাল থেকে আটক করেছে পুলিশ, যার মধ্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এক ছাত্রও রয়েছে।

এর আগে জেএসবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বিস্ফোরক দলে পলিটেকনিক ছাত্রদের সম্পৃক্ততা পাওয়ার গিয়েছিল।

চট্টগ্রামভিত্তিক হেফাজতের নায়েবে আমির মুফতি ইজাহার নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি। এই দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। তার ছেলে হারুনও হেফাজতের নেতা।

জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুফতি ইজাহারকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। পরে জামিনে তিনি ছাড়া পান।  

বিস্ফোরণের এই ঘটনায় মুফতি ইজাহার, হারুন ইজাহারসহ সাতজনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ।

চট্টগ্রামে হেফাজতি মাদ্রাসায় এই ঘটনার দিনই ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় বিস্ফোরক ও গুলিসহ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা দেশজুড়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।

বিস্ফোরণে আতঙ্ক

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সকাল ১১টায় মাদ্রাসার চার তলা ছাত্রাবাস ভবনের (দারুল ইত্তা ভবন) দ্বিতীয় তলার দুই নম্বর কক্ষে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বাঘগোনা ও কুসুমবাগ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

কুসুমবাগ এলাকার বাসিন্দা নাসিমা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হওয়ার পর আমরা ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেই।”

বিস্ফোরণের পর মাদ্রাসা থেকে কিছু জানানো না হলেও এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কর্মীরা।

ফায়ার ব্রিগেডের আগ্রাবাদ স্টেশনের কর্মকর্তা মোনায়েম বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিস্ফোরণের পর ওই ঘরে আগুন ধরে যায়। মাদ্রাসার লোকজন বালি ও পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। আমরা আসার পর আগুন পুরো নিয়ন্ত্রণে আসে।”

বেলা ১২টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ওই কক্ষের জানালা বেঁকে গেছে, কক্ষের ছাদে দুটি ফ্যানও বাঁকা। বিভিন্ন স্থানে খসে গেছে দেয়ালের পলেস্তারা। ঘরের সব কিছুই পুড়ে গেছে। কেবল এক কোনায় একটি লোহার আলনার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে।

ভবনের পেছনের অংশে নিচে একটি লোহার ট্রাংক পড়ে থাকতে দেখা যায়, যার ভেতরে ছিল বিপুল পরিমাণ মার্বেল। ট্রাংটিও ছিল দোমড়ানো।

ঘটনার পর মাদ্রাসায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি কক্ষে বসে কথা বলেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি ইজাহার। তবে এ সময় তিনি বিস্ফোরণের কক্ষটি দেখতে যাননি।

মাদ্রাসার ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি’ কক্ষে মুফতি ইজাহারুল সাংবাদিকদের বলেন, আওয়াজ শোনার পর শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম।

“ওরা বলেছে, ওই রুমে একটি ল্যাপটপ চার্জে ছিল। পাশে একটি রান্নার স্টোভ আর ডেস্কটপ ছিল। এসবের কিছু বিস্ফোরিত হয়েছে। তবে আমি দেখিনি।”

পাশের কক্ষটি হারুন ইজাহারের

দারুল ইত্তা ভবনের তৃতীয় তলায় যে কক্ষে বিস্ফোরণ ঘটে তার পাশের কক্ষটি হারুন ইজাহারের বলে জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী।

এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছাত্রাবাসটি দেখাশোনার দায়িত্বও হারুন ইজাহারের। এখানে শুধু উঁচু ক্লাসের ৫০ জন ছাত্র থাকে।

“তবে বাইরের বিভিন্ন মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে এ ভবনে থাকে। তারা মাদ্রাসা ছাত্রদের বন্ধু পরিচয়ে সেখানে থাকে।”

ওই মাদ্রাসার ভেতর দরজগাহ নামের আরেকটি দ্বিতল ছাত্রাবাস আছে। এ ছাত্রাবাসে বসবাসকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০ জন।

আহতদের নিয়ে লুকোচুরি

বিস্ফোরণের পর আহতদের নিয়ে শুরু হয় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের লুকোচুরি।

আহত পাঁচজনকে শুরুতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসাপাতালে নেয়া হয় বলে মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান। তবে নগরীর দুটি বেসরকারি হাসপাতালে চারজনকে পেয়ে তাদের আটক করেছে পুলিশ।

ঘটনার পর ছাত্রাবাস ভবনের পাশের ঝোঁপের মধ্যে আহত এক শিক্ষার্থীর বিচ্ছিন্ন আঙ্গুলের অংশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে বলে জানান মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এক শিশু, কিন্তু ভয়ে নিজের নাম বলতে চায়নি সে।

এক আলোকচিত্র সাংবাদিক ‘আঙ্গুল সদৃশ’ ওই বস্তুর ছবি তোলার পর মাদ্রাসার অন্য ছাত্রদের রোষানলে পড়ে সেই শিশুটি। পরে মাদ্রাসার ছাত্ররা ‘আঙ্গুল সদৃশ’ বস্তুটি পলিথিন মুড়িয়ে নিয়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী জানায়, বিস্ফোরণের পর ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে একজনকে দৌড়ে যেতে দেখেছেন তিনি। তার মুখমণ্ডল ঝলসানো এবং একটি হাতের কবজি পর্যন্ত প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।

পরে হালিশহর জেনারেল হাসপাতাল এবং পাঁচলাইশ থানাধীন সার্জিস্কোপ নামের দুটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চার যুবককে আটক করে পুলিশ। তারা সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

হালিশহর থানার ওসি শাজাহান কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হালিশহর জেনারেল হাসপাতালে দুইজন চিকিৎসা নিচ্ছিল। তাদের আটক করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এদের মধ্যে নুরুন্নবী নুরুন্নবী নামের একজন পলিটেকনিক ইন্সটিউটের শিক্ষার্থী বলে পুলিশ জানায়। সালমান নামে অন্যজনের বাড়ি সুনামগঞ্জে, বাবার নাম আবদুল হাই।

চট্টগ্রাম মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, দুই যুবকই দগ্ধ, তাদের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।

এছাড়া সার্জিস্কোপ থেকে আরো দুইজনকে আটক করে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে বলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. শহীদুল্লাহ জানান। তবে তাদের নাম জানাননি তিনি।

পুলিশের তদন্ত

মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের তথ্য সংগ্রহে যাওয়া পুলিশের প্রথম দলটির নেতৃত্বে ছিলেন উপ-পরির্দশক (এসআই) গোলাম নেওয়াজ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাদ্রাসার লোকজনের দাবি করেছিল-কম্পিউটারের ইউপিএস বা ল্যাপটপ বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।”

এর এক ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে যায় র‌্যাবের একটি টহল দল। দুপুর ১টায় যায় গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিস্ক্রিয়কারী বিশেষজ্ঞ দল।

তারপর হলুদ টেপ দিয়ে কক্ষটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। এর আগ পর্যন্ত ওই কক্ষে অবাধে যাতায়াত করেন মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিকরা।

বিস্ফোরকের মজুদ

বিস্ফোরণস্থল পরীক্ষা করে পুলিশ বিকালে জানায়, সেখানে বিস্ফোরকের ‘বড় ধরনের মজুদ’ ছিল।

বিকালে মাদ্রাসা ভবন ঘুরে দেখে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরণ ঘটার পর দমকল বাহিনী আগুন নিভিয়েছে। ছাইয়ের নিচে বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে।

“আমরা নিশ্চিত, এখানে বিস্ফোরক দ্রব্যের বড় ধরনের মজুদ ছিল। হাতে তৈরি শক্তিশালী কিছু গ্রেনেডও এখানে রয়েছে। এগুলো বেশ বিপদজ্জনক।”

গ্রেনেডের সংখ্যা গুণে দেখা না হলেও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ শুরু করেছে বলে কমিশনার জানান।

বিস্ফোরণের পর ছাত্রাবাস ভবনটি খালি করে ঘিরে রেখে কাজ করে ডিবি, সিআইডি ও বোমা নিস্ক্রিয়কারী দল ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা।

মহানগর পুলিশ কমিশনার ছাড়াও অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কমুরা মজুমদার, উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা) কুসুম দেওয়ান  ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. শহীদুল্লাহ ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেছেন।

তল্লাশি অভিযান

বিকালে নগর পুলিশের কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ওই মাদ্রাসায় তল্লাশি শুরু হয়।

সাড়ে তিন ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে ১৮ বোতল পিকরিক এসিড জব্দ এবং পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ।

মাদ্রাসার ভেতরে প্রিন্সিপাল মুফতি ইজাহারের কার্যালয় থেকে ১৮ বোতল পিকরিক এসিড উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশ জানায়।

উদ্ধার করা বোতলের গায়ে মেইড ইন ইন্ডিয়া এবং এক্সপ্লোসিভ লেখা আছে, বলেন এডিসি শহীদ।

এডিসি শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, ছাত্রাবাস থেকে তিনটি তাজা হ্যান্ড গ্রেনেড ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।

বিকাল ৫টা পর্যন্ত মাদ্রাসার ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি’ বিভাগেই ছিলেন মুফতি ইজাহার। এরপর তাকে আর দেখা যায়নি।সাড়ে ৬টায় পুলিশ অভিযান শুরু করে। অভিযান শেষে জানায়, মুফতি ইজাহার ও হারুনকে পাওয়া যায়নি। 

মুফতি ইজাহারকে সরে যেতে সহায়তা করা হয়েছে কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং মাদ্রাসাটি নজরদারিতে থাকবে।”