বিস্ফোরকের মজুদ ছিল ইজাহারের মাদ্রাসায়: পুলিশ

হেফাজতে ইসলামের নেতা মুফতি ইজাহার পরিচালিত মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে বিস্ফোরণস্থল পরীক্ষা করে পুলিশ জানিয়েছে, সেখানে বিস্ফোরকের ‘বড় ধরনের মজুদ’ ছিল।

উত্তম সেনগুপ্ত, চট্টগ্রাম অফিসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2013, 12:18 PM
Updated : 7 Oct 2013, 02:13 PM

এ ঘটনায় দুটি হাসপাতাল থেকে আহত চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।

সোমবার সকাল ১১টার দিকে নগরীর খুলশী থানার লালখান বাজার এলাকায় জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার চার তলা ছাত্রাবাস ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে ওই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওই কক্ষের সব কিছু পুড়ে যায়, আহত হন অন্তত পাঁচ জন।

ওই ঘটনার পর মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা দাবি করেন, কম্পিউটারের ইউপিএস বা ল্যাপটপ বিস্ফোরিত হয়ে ওই ঘরে আগুন লেগে যায়।

ঘটনাটি নিয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের লুকোচুরি চললেও বিকট শব্দে বিস্ফোরণ, ট্রাংক ভর্তি মার্বেল উদ্ধার, আহতদের গোপনে চিকিৎসা নেয়া, বিচ্ছিন্ন হাতের আঙ্গুল সরিয়ে ফেলার অভিযোগ মিলিয়ে সকাল থেকেই ‘গুরুতর’ কিছুরই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল সেখানে।

এরপর বিকালে মাদ্রাসা ভবন ঘুরে দেখে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরণ ঘটার পর দমকল বাহিনী আগুন নিভিয়েছে। ছাইয়ের নিচে বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে।

“আমরা নিশ্চিত, এখানে বিস্ফোরক দ্রব্যের বড় ধরনের মজুদ ছিল। হাতে তৈরি শক্তিশালী কিছু গ্রেনেডও এখানে রয়েছে। এগুলো বেশ বিপদজ্জনক।”

গ্রেনেডের সংখ্যা গুণে দেখা না হলেও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ শুরু করেছে বলে কমিশনার জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফরের আগে এ ধরনের ঘটনা উদ্বেগের বিষয়।”

সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এ ঘটনায় আহত দুই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে।”

সকালে ঘটনার পর হেফাজতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুফতি ইজাহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ওই ঘরে কম্পিউটারের ইউপিএস বা ল্যাপটপ বিস্ফোরিত হয়েছে বেলে তিনি ছাত্রদের কাছে শুনেছেন। তবে নিজে দেখেননি।

মুফতি ইজাহার নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিরও সভাপতি। 

বিস্ফোরণের পর থেকে মাদ্রাসার দারুল ইত্তাহ বিভাগের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত ভবনটি খালি করে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দমকল বাহিনী ও বোমা নিস্ক্রিয়কারী দল বিকালেও সেখানে কাজ করছিল।

মহানগর পুলিশ কমিশনার ছাড়াও অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কমুরা মজুমদার, উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা) কুসুম দেওয়ান  ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. শহীদুল্লাহ ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেছেন।

হাসপাতাল থেকে আটক চার

লালখান বাজার মাদ্রাসায় বিস্ফোরণে আহত চার যুবককে হালিশহর জেনারেল হাসপাতাল ও পাঁচলাইশ থানাধীন সার্জিস্কোপ নামের দুটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আটক করেছে পুলিশ। তারা সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

হালিশহর থানার ওসি শাজাহান কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হালিশহর জেনারেল হাসপাতালে দুইজন চিকিৎসা নিচ্ছিল। তাদের আটক করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়

এদের মধ্যে সালমান (২৫) নামে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার বাড়ি সুনামগঞ্জে, বাবার নাম আবদুল হাই। আহত অপরজনের বয়স আনুমানিক ২২ বছর বলে পুলিশ জানিয়েছে।

তারা দুইজনই লালখান বাজারের মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত হন বলে ওসি জানান।

চট্টগ্রাম মেডেকেল পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক পঙ্কজ বড়–য়া জানান, দুই যুবকই দগ্ধ, তাদের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।

এছাড়া সার্জিস্কোপ থেকে আরো দুইজনকে আটক করে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে বলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. শহীদুল্লাহ জানান।তবে তাদের নাম জানাননি তিনি।

দিনভর লুকোচুরি

সকালে বিস্ফোরণের পর আহতদের নিয়ে শুরু হয় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের লুকোচুরি।

আহত পাঁচজনকে শুরুতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসাপাতালে নেয়া হয় বলে মাদ্রাসার শিক্ষকরা জানান। কিন্তু দুপুর দেড়টার দিকে আহত দুই জনের দেখা মেলে নগরীর অপর প্রান্ত হালিশহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে তাদের আটক করে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠায় পুলিশ।

মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের তথ্য সংগ্রহে যাওয়া পুলিশের প্রথম দলটির নেতৃত্বে ছিলেন উপ-পরির্দশক (এসআই) গোলাম নেওয়াজ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাদ্রাসার লোকজনের দাবি করেছিল-কম্পিউটারের ইউপিএস বা ল্যাপটপ বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।”

এর এক ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে যায় র‌্যাবের একটি টহল দল। দুপুর ১টায় যায় গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিস্ক্রিয়কারী বিশেষজ্ঞ দল।

তারপর হলুদ টেপ দিয়ে কক্ষটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। এর আগ পর্যন্ত ওই কক্ষে অবাধে যাতায়াত করেন মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিকরা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সকালে মাদ্রাসার চার তলা ছাত্রবাস ভবনের দ্বিতীয় তলার তিন নম্বর কক্ষে যখন বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে, তখন পাশের বাঘগোনা ও কুসুমবাগ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

কুসুমবাগ এলাকার বাসিন্দা নাসিমা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হওয়ার পর আমরা ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেই।”

বিস্ফোরণের পর মাদ্রাসা থেকে কিছু জানানো না হলেও এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কর্মীরা।

ফায়ার ব্রিগেডের আগ্রাবাদ স্টেশনের কর্মকর্তা মোনায়েম বিল্লাহ বলেন, “বিস্ফোরণের পর ওই ঘরে আগুন ধরে যায়। মাদ্রাসার লোকজন বালি ও পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। আমরা আসার পর আগুন পুরো নিয়ন্ত্রণে আসে।”

বেলা ১২টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ওই কক্ষের জানালা বেঁকে গেছে, কক্ষের ছাদে দুটি ফ্যানও বাঁকা। বিভিন্ন স্থানে খসে গেছে দেয়ালের পলেস্তারা। ঘরের সব কিছুই পুড়ে গেছে। কেবল এক কোনায় একটি লোহার আলনার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে।

ভবনের পেছনের অংশে নিচে একটি লোহার ট্রাংক পড়ে থাকতে দেখা যায়, যার ভেতরে ছিল বিপুল পরিমাণ মার্বেল। ট্রাংটিও ছিল দোমড়ানো।

ঘটনার পর ছাত্রাবাস ভবনের পাশের ঝোপের মধ্যে আহত এক শিক্ষার্থীর বিচ্ছিন্ন আঙ্গুলের অংশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে বলে জানান মাদ্রাসার এক কম বয়সী শিক্ষার্থী।

এক আলোকচিত্র সাংবাদিক ‘আঙ্গুল সদৃশ’ ওই বস্তুর ছবি তোলার পর মাদ্রাসার অন্য ছাত্রদের রোষানলে পড়ে সেই শিশুটি। পরে মাদ্রাসার ছাত্ররা ‘আঙ্গুল সদৃশ’ বস্তুটি পলিথিন মুড়িয়ে নিয়ে যায়।

ঘটনার পর মাদ্রাসায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের একটি কক্ষে বসে স্বাগত জানান প্রিন্সিপাল মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী। তবে এ সময় তিনি বিস্ফোরণের কক্ষটি দেখতে যাননি।

মাদ্রাসার ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি’ কক্ষে মুফতি ইজাহারুল সাংবাদিকদের বলেন, আওয়াজ শোনার পর শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। ওরা বলেছে, ওই রুমে একটি ল্যাপটপ চার্জে ছিল। পাশে একটি রান্নার স্টোভ আর ডেস্কটপ ছিল। এসবের কিছু বিস্ফোরিত হয়েছে। তবে আমি দেখিনি।”