‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’

শ্রেণি-পেশা আর রাজনৈতিক পরিচয়ের ভেদ ভুলে শাহবাগের অভূতপূর্ব মহাসমাবেশে একাত্তরের হত্যাকারী আর ধর্ষকদের ফাঁসি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন লাখো জনতা।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবসুলাইমান নিলয়, আশিক হোসেন, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রিতম, ও সুজন মণ্ডলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2013, 06:12 AM
Updated : 8 Feb 2013, 09:35 AM

একই সঙ্গে জামায়াত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জনেরও ঘোষণা এসেছে এই সমাবেশ থেকে।

মহাসমাবেশের পরও অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এ উদ্যোগের আয়োজকরা।

শপথে বলা হয়, “একাত্তরের ঘৃণ্য রাজাকার, আল বদর, গণহত্যা ও ধর্ষণকারীদের ‍মৃত্যুদণ্ড না হওয়া পর্যন্ত এই গণমানুষের মঞ্চ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।

“৭৫ পরবের্তী যেসব স্বাধীনতাবিরাধীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্ভুক্ত করার কাজ করতে হবে।”

যুদ্ধাপরাধীদের ব্যবসায়িক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বলা হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে জামায়াত-শিবির অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় শপথ- “গৃহযুদ্ধের হুমকিদাতা জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়ে যাব।”

“ফোকাস ইবনে সিনা রেটিনা ইসলামি ব্যাংকসহ জামায়াতের যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বয়কট করব। যে সব শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শিশুদের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চিন্তা তৈরি করছে। সেসব বর্জন করব। এক কথায় রাজাকার আলবদরদের সকল রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বয়কট করব।

“ভিডিও চিত্র ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের হুমকিদাতাদের বিচারের আওতায় আনতে কাজ করব। দিগন্ত টিভি, নয়া দিগন্ত পত্রিকা, ইসলামি টিভি, আমার দেশ, সংগ্রাম এবং জামায়াতের ব্লগ সোনার বাংলা বয়কট করব। অফিস আদালত বাসগৃহ কোথাও যুদ্ধাপরাধীদর কোনো পত্রিকা রাখা যাবে না।”

বিকাল ৩টায় শাহবাগ মোড়ে একটি ছোট ট্রাকে তৈরি মূলমঞ্চ থেকে চরমপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের এ সম্মিলিত প্রতিবাদ। চরমপত্র পড়ে শোনান ব্লগার শহীদুল ইসলাম রাজু।

এরপর সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি।

এ সময় চারদিক থেকে মানুষের ঢল নামতে থাকে শাহবাগের সমাবেশস্থলে। কিছুক্ষণের মধ্যে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর, বাংলামটর, কাঁটাবন ও মৎস্যভবন পর্যন্ত চারপাশের সড়ক পূর্ণ হয় মানুষে।

সমাবেশের মূলমঞ্চে অঞ্জন রায়ের উপস্থাপনায় এবং মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর সহযোগিতায় একে একে বক্তব্য দেন মুক্তিযোদ্ধা, তাদের স্বজন এবং বিভিন্ন অঙ্গেনের বরেণ্যজনেরা।

এরপর সমবেত সবাইকে নিয়ে শপথ পড়েন সমাবেশের সভাপতি ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেট্ওয়ার্কের ইমরান এইচ সরকার। তার আগে চারদফা দাবি ঘোষণা করেন তিনি।

দাবিগুলোর হলো- সব যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে হবে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। গৃহযুদ্ধের হুমকিদাতাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনকারী সকল শক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার বিকালে শাহবাগ মোড়ে এই বিক্ষোভের সূচনা করে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেওয়ার্ক। এরপর রাতেই তা পরিণত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে।

সেই থেকে সকাল-দুপুর-রাত বিরামহীন চলছে শাহবাগের এই অবস্থান। এই জাগরণের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সব জেলায় চলছে একই রকম সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি।  

বুধবার শাহবাগের অবস্থান থেকে বৃহস্পতিবার সমাবেশ ও শুক্রবার মহাসমাবেশ করার ঘোষণা আসে। সে অনুযায়ী শুক্রবার সকাল থেকেই রাজধানী ও এর আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ঢাকঢোল বাজিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থলে।

বেলা ১টা নাগাদ জমায়েত কাঁটাবন থেকে শিশুপার্ক, বিএসএমএমইউ থেকে চারুকলা অনুষদ ছাড়িয়ে যায়।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের অংশগ্রহণ, শ্লোগানের কণ্ঠ। এক পর্যায়ে সমাবেশ এলাকা থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ছাড়া অন্য সব সাংগঠনিক ব্যানার সরিয়ে ফেলা হয়। এই জমায়েতকে একটি ‘অরাজনৈতিক’ রূপ দিতেই এটা করা হয় বলে আয়োজকরা জানান।

বেলা ৩টায় মহাসমাবেশ শুরুর সময় পুরো এলাকা জনসমুদ্রের রূপ নেয়। জনতার মাঝে ক্ষণে ক্ষণে স্লোগানের ঢেউ ওঠে- ক তে কাদের মোল্লা/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, স তে সাইদি/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, ম তে মুজাহিদ/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, ন তে নিজামি/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, গ তে গোলাম আযম/তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, জামাত শিবির রাজাকার/এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।

আর সব ছাপিয়ে মাঝেমধ্যেই লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংলা’ ধ্বণি, যে স্লোগান মুখে নিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার মানুষ।