বামপন্থী দলগুলোর বুধবারের হরতালে পুলিশের পেপার স্প্রের শিকার হন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী মন্টি বৈষ্ণব।
পুরানা পল্টনে আক্রান্ত মন্টিকে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে শুশ্রূষা করেন দলের সহকর্মীরা। কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁঝ থেকে মুক্তির মতো এক্ষেত্রেও কেউবা কাগজ পুড়িয়ে, কেউবা চোখে পানি দিয়ে মন্টিকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।
তবে ব্যর্থ হয়ে শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হয় ছাত্র ইউনিয়নের এই নেত্রীকে।
বিক্ষোভ দমনে পুলিশের পেপার স্প্রে ব্যবহার এটাই প্রথম নয়, এর আগে এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপরও তা ব্যবহার করেছে পুলিশ।
বুধবার ব্যবহারের পর পুলিশের সর্বসাম্প্রতিক এই ‘হাতিয়ার’ নিয়ে বেশ আলোচনা উঠেছে বিভিন্ন মহল ও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে।
এটি ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে তা নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে আক্রান্তরা। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি কোনোভাবেই প্রাণ সংহারী নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মন্টি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজেকে অন্ধ মনে হচ্ছিল। চোখের সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও জ্বালাপোড়া শুরু হয়।”
এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকদের কর্মসূচিতে গত ১০ জানুয়ারি নতুন আমদানি করা এই ‘হাতিয়ারের’ ব্যবহারের পর থেকেই আলোচনার শুরু।
পেপার স্প্রে বিভিন্ন দেশে ওসি স্প্রে (ওলেওরেসিন ক্যাপসিকাম), ওসি গ্যাস ও ক্যাপসিকাম স্প্রে নামেও পরিচিত।
এর মধ্যে এমন রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা চোখে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে। এই গ্যাসের সংস্পর্শে আসামাত্র চোখে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
নর্থ ক্যারোলাইনা মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওসি স্প্রে বা পেপার স্প্রেতে পানি, অ্যালকোহল, কার্বনডাইঅক্সাইড, হ্যালোজেনেটেড হাইড্রোকার্বন (ফ্রেয়ন, টেট্রাক্লোরোথাইলিন, মিথাইলিন ক্লোরাইড) রাসায়ানিকও ব্যবহার করা হয়।
এসব রাসায়নিকের প্রভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটিয়ে আকস্মিক মৃত্যুও ঘটাতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।
আশির দশকে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে নেদারল্যান্ডস অ্যান্টিলিজের পুলিশ বাহিনী প্রথম এই স্প্রে ব্যবহার করে, যা মূলত জার্মান পুলিশের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
পেপার স্প্রে ব্যবহার করতে হলে অন্তত ১৫ ফুট দূর থেকে তা ছুড়তে হয়।
বুধবারের হরতালে এই গ্যাস ব্যবহারের ঘটনাকে ‘মানবতাবিরোধী’ আখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
তিনি বলেন, “পশ্চিমা দেশগুলোতে এক সময় মরিচ পানি ব্যাবহার করা হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বর্তমানে এটি আর ব্যবহার করা হয় না।”
আইন রক্ষার কথা বলে সরকার জনগণকে নাজেহাল করতে এ ধরনের একটি অস্ত্র ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেন সেলিম।
একই মন্তব্য করে এই স্প্রের ব্যবহার নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
তিনি বলেন, “পেপার স্প্রেতে আক্রান্ত হয়ে আমাদের বহু নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। এটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এতে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। ইতোমধ্যে এর প্রভাবে এক শিক্ষকেরও মৃত্যু হয়েছে।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা ড. সিমরন বুধবার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, হাসপাতালে হাজিরা বই অনুযায়ী এদিন পাঁচ থেকে ছয় জন এই গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, “এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে নতুন। তবে আমার কাছে মনে হয়, এর কোন দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব শরীরে পড়ার কথা নয়। চোখ অনেক সেনসিটিভ একটি অঙ্গ হওয়ায় এর কারণে সাময়িক প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।”
এদিকে জরা না থাকলে পেপার স্প্রেতে মৃত্যুর কোনো ঝুঁকি নেই বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
এই নতুন অস্ত্র যাদের হাতে, সেই পুলিশও বলছে- এতে মৃত্যুর কোনো ঝুঁকি নেই। এটি টিয়ার গ্যাসের আধুনিক সংস্করণ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা রক্ষার কাজের সহায়ক হিসেবে এটি ব্যবহার করে থাকে। এতে আক্রান্ত কেউ দীর্ঘ মেয়াদি শারীরিক ক্ষতির মুখোমুখি হয় না।”
পেপার স্প্রে দেশের বাইরে থেকে আনা হয় বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান।