পাওনা টাকা পেতে আমিনের ‘পেছনে পেছনে ঘুরছিলেন’ গাজী আনিস

হেনোলাক্স কোম্পানির মালিক নুরুল আমিনের কাছ থেকে পাওনা টাকা উদ্ধারে দেন-দরবার চালালেও রাজনৈতিক কোনো প্রভাব খাটাতে চাইতেন না আনিসুর রহমান, যিনি গাজী আনিস নামেই বেশি পরিচিত।

গোলাম মর্তুজা অন্তু জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2022, 04:14 PM
Updated : 5 July 2022, 04:14 PM

কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আনিস, জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতেও ছিলেন। ফলে ক্ষমতাসীন দলটির প্রভাবশালী নানা নেতার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল।

কিন্তু নিজের টাকা উদ্ধারে রাজনৈতিক সেই পরিচয় তিনি কাজে লাগাতে চাননি বলে জানান তার মামাত ভাই তানভীর ইমাম। ঢাকায় এলে ব্যবসায়িক নানা বিষয়ে এই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতেন আনিস।

গাজী আনিস।

তানভীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টাকার জন্য উনি অনেকদিন ধরেই হেনোলাক্সের আমিন সাহেবের পেছন পেছন ঘুরছিলেন। এর আগে এক দফা দেন-দরবারও হয়। আমিন সাহেব একাধিক চেক দেন। একটি চেক মনে হয় ভাঙাতে পেরেছিলেন। বাকি চেকগুলো বাউন্স করে। এ নিয়ে তিনি কুষ্টিয়া সদরে মামলাও করেন।

“তিনি আইনি প্রক্রিয়াতেই এগোতে চাইছিলেন। তার রাজনৈতিক যে পরিচিতি, সেটিকে তিনি ব্যবহার করতে চাইতেন না। আমি অনেকবার বলছি- ভাই অন্তত হানিফ (মাহাবুব-উল আলম হানিফ) ভাইকে বিষয়টা জানান। তিনি একটা কিছু করবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু তিনি তা জানাননি।”

“আত্মীয়-স্বজনেরা তার ঝামেলায় পড়ে হেনস্থার শিকার হতে পারেন, এই ভয়ে কাউকেই জড়াতেন না। তাদের এক ভাই সরকারি কর্মকর্তা। আমি তাকে বলেছি ওই ভাইয়ের কাছে বিষয়টা বলে পুলিশের মাধ্যমে এগোনোর জন্য। তিনি সেদিকেও যাননি,” বলেন তানভীর।

তানভীরের ভাষ্যে ‘আবেগী’ গাজী আনিস পাওনা টাকা উদ্ধার করতে না পারার যন্ত্রণার কথা জানিয়ে সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি, একদিন পরই তার মৃত্যু হয়।

আনিসের মৃত্যুর পর তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে তার ভাই নজরুল ইসলাম আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

নজরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ভাই আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের ‘দুঃসময়’। সে সময় কুষ্টিয়া সংগঠনের পেছনে তার অবদান অনেক। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও তিনি কখনও কোথাও তার সেই পরিচয় ব্যবহার করতে না।

“তিনি আমার কাছেও বেশি কিছু বলতেন না। খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলেন এবং নিজেই চেষ্টা করতেন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য।”

মামলার দাবি অনুযায়ী, আমিন ও তার স্ত্রীকে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা আনিস দিয়েছিলেন হেনোলাক্স কোম্পানিতে অংশীদার হতে। সব মিলিয়ে লভ্যাংশ হিসেবে এখন ৩ কোটি টাকা পাওনা হয়েছে।

নজরুলের দাবি, ২০১৮ সালে ওই বিনিয়োগের পর প্রথমে কিছুদিন তার ভাইকে লভ্যাংশ দিলেও পরে তা বন্ধ করে দেন আমিন। বিনিয়োগের চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরেও গড়িমসি করেন। এরপর টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেও না পেয়ে কুষ্টিয়ায় মামলা করেন। ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনও করেন গত ২৯ মে।

তানভীর বলেন, “ওইদিন গ্রামে আমাদের একটা মাদ্রাসা নিয়ে মিটিং ছিল। আমার সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে। কিন্তু একবারও বলেননি যে তিনি পাওনা টাকা আদায়ের জন্য ঢাকায় যুদ্ধ করছেন।”

মামলায় বলা হয়, ‘‘গত ৪ জুলাই বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে আনিসুর রহমান তাকে ফোন করে জানায় ওই দিন বিকালে হেনোলাক্সের কর্ণধাররা পাওনা টাকার চেক দিবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু বিকালে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন চেক দেয়নি।”

এরপরই প্রেস ক্লাবে এসে গায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন আনিস।

স্বজনরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত এভাবে প্রাণ দেবেন গাজী আনিস, তা তারা ভাবতেও পারেননি।

গত ৩১ মে তিনি পাওনা টাকার বিষয়ে ফেইসবুকে একটা পোস্ট দেন। তখন জানতে পেরে অনেক আত্মীয়-স্বজন তাকে ফোন করেন। কিন্তু তিনি কারও কাছেই সাহায্য চাননি।

মৃত্যুর তিন দিন আগে নিজের গাড়ি ও মোটর সাইকেল বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।

‘কবি’ ডাকলে খুশি হতেন আনিস

রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তারপর করতেন ঠিকাদারি; কিন্তু নিজেকে কবি ভাবতেন গাজী আনিস।

তাই কেউ কবি ডাকলেই তিনি খুশি হতেন বলে জানান তানভীর।

তিনি বলেন, “আবেগী ছিলেন। কবিতা লিখতেন। নয়টা বই বেরিয়েছে। গত বইমেলাতেও তার বই বেরিয়েছে। তাকে কবি বললে খুশি হতেন।”

নিহতের ভাই আব্দুর রশীদ জানান, তারা সাত ভাই ও চার বোনের মধ্যে আনিস তৃতীয়।

৫০ বছর বয়সী গাজী আনিসের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি গ্রামে। তবে স্ত্রী তিন মেয়েকে নিয়ে থাকতেন যশোরে। তার বড় মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী, মেজ মেয়ে এসএসসি দেবে। আর ছোট মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে।

তানভীর বলেন, “মেয়েদের পড়াশোনার জন্য তার স্ত্রী ও তিন মেয়ে যশোরে থাকেন। তিনি কুষ্টিয়ায় ব্যবসা করতেন। বেশ স্বচ্ছল ছিল বলেই সবাই জানতেন। তার টয়োটা এক্স করোলা গাড়ি ছিল, বাজাজের একটা মোটর সাইকেলও ছিল।

“মারা যাওয়ার তিন দিন আগে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি ও মোটর সাইকেল বেচে আসেন। অন্তত ১০ লাখ টাকার গাড়ি ৬ লাখে ও মোটর সাইকেলটা মাত্র ২৫ হাজারে বেচেছেন।”

হঠাৎ তার এত টাকা কেন লাগল, তা স্বজনদের কেউ জানে না। সে টাকা তিনি কোথায় খরচ করলেন, তাও অজানা।

বন্ধ হেনোলাক্সের অফিস

মামলার পর মঙ্গলবার দুপুরে পল্টনে ‘স্কাই ভিউ হেনোলাক্স সেন্টারে’ গিয়ে জানা যায়, সকাল থেকেই হেনোলাক্সের অফিস বন্ধ।

পুরানা পল্টনের ১১ তলা এই ভবনটির তৃতীয় তলায় হেনোলাক্সের অফিসে বসতেন নুরুল আমিন। সোমবারও তিনি অফিসে এসেছিলেন। তবে মঙ্গলবার অফিস খোলেননি।

অফিসের বন্ধ কলাপসিবল দরজায় হকারের দিয়ে যাওয়া দিনের সংবাদপত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ওই অফিসের পাশেই ‘ইনো হোমিও’র কর্মীরা জানান, মঙ্গলবার হেনোলাক্সের অফিসটি খোলেনি।

এদিকে হেনোলাক্স সেন্টারের নিরাপত্তাকর্মীদের একজন আব্দুল হাকিম জানান, একটা ঘটনার কথা তারা শুনেছেন। এরপর নুরুল আমিনকে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে গেছে বলেও তারা শুনেছেন। মঙ্গলবার অফিস খোলেনি, তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নেই তাদের কাছে।

মঙ্গলবার বিকালে নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র‌্যাব।