আত্মহত্যায় প্ররোচনা: হেনোলাক্সের নুরুল আমিন ও স্ত্রী গ্রেপ্তার

গায়ে আগুন দিয়ে ঠিকাদার গাজী আনিসের আত্মহত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আমিন ম্যানুফাকচারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন এবং পরিচালক ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।  

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2022, 02:33 PM
Updated : 6 July 2022, 12:17 PM

এ বাহিনীর সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান মঙ্গলবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

আনিসের আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে তার বড় ভাই নজরুল ইসলাম মঙ্গলবার দুপুরে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। ওই মামলাতেই আমিন ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।   

৫০ বছর বয়সী আনিসের বাড়ি কুষ্টিয়ায়, তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই সদস্য এক সময় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিও ছিলেন। পরিচিত জনরা তাকে গাজী আনিস নামেই চেনেন।  

সোমবার বিকালে প্রেস ক্লাবের ফটকের ভেতরে খোলা জায়গায় আনিস নিজের গায়ে আগুন দেন। শোয়া অবস্থায় তার গায়ে আগুন জ্বলছে দেখে আশপাশ থেকে সবাই ছুটে যান। তারা পানি ঢেলে আগুন নেভান। তবে ততক্ষণে তার গায়ের পোশাক সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।

পরে তাকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।

আনিসকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়ার সময় ছিলেন মো. আলী নামে এক সংবাদকর্মী। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “তার সঙ্গে একটু কথা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, একটি কোম্পানির কাছ থেকে তিনি ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা পাবেন। ওই কোম্পানি তা দিচ্ছে না। পাওনা পেতে তিনি এর আগে মানববন্ধন করেছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই তিনি নিজের গায়ে আগুন দেন।”

গত ২৯ মে ঢাকায় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হেনোলাক্স গ্রুপে সোয়া কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ‘প্রতারিত’ হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন আনিস।

তার দুদিন পর ৩১ মে এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি হেনোলাক্স গ্রুপের মালিকের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্রপাত এবং বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগগুলো তুলে ধরেছিলেন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে যতটুকু জেনেছি নুরুল আমিন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর হোমিও কলেজে ভর্তি হন। সেখানে লেখাপড়া শেষে হোমিও ডাক্তার হিসাবে চেম্বার দেন।”

আমিনের বাড়িও কুষ্টিয়ায় জানিয়ে তিনি বলেন, “নুরুল আমিন এই হোমিও ডাক্তার থেকে আমিন গ্রুপ গঠন করেন। আমিন গ্রুপেরই একটি অংশ হেনোলাক্স বা আমিন হারবাল। এই হেনোলাক্স বা হারবালের মাধ্যমে সে সম্পদশালী হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তার ব্যাপারে আরো খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।”

গাজী আনিস।

শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ২০১৬ সালে হেনোলাক্সের কর্ণধার ডা. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা হয় তার ভাই ‘আনিসুরের’। তারা একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণও করেন। তাদের মধ্যে ‘খুবই সখ্য’ গড়ে উঠে। ২০১৮ সালে তারা (নুরুল দম্পতি) হেনোলাক্স কোম্পানিতে ‘লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে’ বিনিয়োগ করার জন্য আনিসুর রহমানকে অনুরোধ করেন।

“তাদের অনুরোধে বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রথমে এক কোটি এবং পরে তার বন্ধুর কাছ থেকে আরও ২৬ লাখ টাকা নিয়ে আনিসুর হেনোলাক্সে বিনিয়োগ করেন।”

এ বিনিয়োগের প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদন করা হলেও হেনোলাক্সের পক্ষ থেকে ওই দুইজন চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদন করতে ‘গড়িমসি করেন’ অভিযোগ করে এজাহারে বলা হয়, “এরই মধ্যে কিছুদিন আমার ভাইকে লভ্যাংশ দিলেও পরে তা বন্ধ করে দেয় এবং চূড়ান্ত চুক্তি করতে গড়িমসি করে।“

পরে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমিন বিভিন্ন লোক দিয়ে ‘নানাভাবে হেনস্তা এবং ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন’ বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।

লভ্যাংশসহ এখন পর্যন্ত তিন কোটি টাকা পাওনা রয়েছে দাবি করে এজাহারে বলা হয়, ওই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেও না পেয়ে কুষ্টিয়ায় হেনোলাক্সের দুইজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন আনিসুর।

এজাহারে নজরুল ইসলাম বলেছেন, গত ৪ জুলাই বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে আনিসুর রহমান তাকে ফোন করে জানান, ওই দিন বিকালে পাওনা টাকার চেক হেনোলাক্সের কর্ণধার ডা. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিন দেবেন বলে তাকে জানিয়েছেন। কিন্তু বিকালে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো চেক দেননি।

এর পরপরই প্রেস ক্লাবে এসে আনিস গায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন এবং পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে মঙ্গলবার সকালে তার মৃত্যু হয় জানিয়ে এজাহারে বলা হয়, ‘প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চেক না দিয়ে এবং বিরূপ আচরণ করে’ আনিসুর রহমানকে আত্মহত্যা করতে ‘প্ররোচিত করা হয়েছে’।

নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ভাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

“কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের দুঃসময়। সে সময় সংগঠনের পিছনে তার অবদান অনেক। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও তিনি কখনও কোথাও তার সেই পরিচয় ব্যবহার করতে না, প্রভাব খাটাতেন না।

“তিনি আমার কাছেও বেশি কিছু বলতেন না। খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলেন এবং নিজেই চেষ্টা করতেন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য।”

মামলার পর মঙ্গলবার দুপুরে পল্টনে ‘স্কাই ভিউ হেনোলাক্স সেন্টারে’ গিয়ে জানা যায়, সকাল থেকেই হেনোলাক্সের অফিস বন্ধ।

পুরানা পল্টনের ১১ তলা এই ভবনটির তৃতীয় তলায় হেনোলাক্সের অফিসে বসতেন নুরুল আমিন। সোমবারও তিনি অফিসে এসেছিলেন। তবে মঙ্গলবার অফিস খোলেনি।

তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের একটি ফোন নম্বরে পাওয়া গেলেও সেখানে কল করা হলে কেউ ধরেননি।