শর্তসাপেক্ষে ‘হাফ’ ভাড়া প্রত্যাখ্যান, বিক্ষোভ কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের

কেবল ঢাকা মহানগরে শর্তসাপেক্ষে ‘হাফ’ ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা প্রত্যাখান করে সারা দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে নয় দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2021, 09:39 AM
Updated : 30 Nov 2021, 11:55 AM

মঙ্গলবার ঢাকার বনানীতে বিআরটিএ ভবনে গিয়ে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে নিজেদের দাবিনামা তুলে ধরার পর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের সামনে নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি, স্টেট কলেজের শিক্ষার্থী এনজামুল হক রামিম বলেন, নয় দফা দাবিতে বুধবার সারাদেশে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে।

সরকার বাসের ভাড়া বাড়ানোর পর থেকে শিক্ষার্থীরা আগের মত অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। প্রতিদিনই তারা  বিভিন্ন এলাকায় সড়ক আটকে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। 

এর মধ্যে ২৪ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী এবং সোমবার রাতে রামপুরায় বাসের চাপায় এক এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার সকালে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ’ ভাড়ার দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

বাস মালিকদের ঘোষণা অনুযায়ী, বাসে ‘হাফ’ ভাড়া দেওয়া যাবে কেবল সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৮টার মধ্যে। সরকারি ছুটির দিন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ছুটির দিনে ‘হাফ’ ভাড়া দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। কেবল ঢাকা মহানগরের জন্যই এ সুযোগ প্রযোজ্য হবে। 

ওই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ঢাকার রামপুরা, নীলক্ষেত, ধানমণ্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলতে থাকে। পরে বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দল ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ এর ব্যানার নিয়ে বিআরটিএ ভবনের সামনে অবস্থান নেন।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক কবি নজরুল কলেজের ছাত্র শাহাদাত হোসেন সেখানে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাস মালিকদের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ শর্তসাপেক্ষে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন তা আমরা মানছি না। ঢাকার বাইরেও লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী বাসে যাতায়াত করে। শিক্ষার্থীদের অনেকে ভোর ৬টায় উঠে বাসে করে কোচিংয়ে যায়, ক্লাস ধরতে যায়। অনেক শিক্ষার্থী টিউশনি শেষে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে। তাদের ক্ষেত্রে কি হবে?”

শিক্ষার্থীদের তিনজন প্রতিনিধি পরে ভেতরে গিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সাথে দেখা করে তাদের নয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে তারা বুধবার বিক্ষোভের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র এনজামুল হক রামিম বলেন, “আমরা মালিক পক্ষের হাফ ভাড়ার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করলাম। আমরা চাই শুধু বাসে নয়; লঞ্চ ও ট্রেনও হাফ ভাড়ার আওতাভুক্ত হোক, সেটা সারা দেশে এবং ২৪ ঘণ্টা।”

বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। তার সাথে সন্তোষজনক আলোচনা হয়নি। আবার তার সাথে কথা হবে।”

দিনভর বিক্ষোভ

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবারও রাজধানীর কাকরাইল, রামপুরা, ধানমণ্ডি এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে। পুলিশ ও সরকারি সেবা সংস্থার যানবাহনসহ বিভিন্ন গাড়ির কাগজপত্র ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে তারা।

গাড়ির কাগজ না পেলে বা চালক লাইসেন্স দেখাতে না পারলে শিক্ষার্থীরা তাদের ভর্ৎসনা করছেন। সরকারি সংস্থার বেশ কয়েকজন চালক শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্চিতও হয়েছেন।

সোমবার রাতে পূর্ব রামপুরায় বাসের চাপায় একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া মো. মাইনউদ্দিনের মৃত্যুতে মঙ্গলবার শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ নতুন মাত্রা পায়।

ঢাকা ন্যাশনাল কলেজ, ক্যাম্ব্রিয়ান কলেজ ও বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল পৌনে ১০টার থেকে রামপুরা ব্রিজে অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।

এসময় ডিআইডি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান। পরে দুপুর ৩টার দিকে তারা রাস্তা ছেড়ে গেলে যান চলাচল শুরু হয়।

সড়ক ছেড়ে যাওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, নিরাপদ সড়কের নয় দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।

খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া সেখানে বলেন, “আমাদের আন্দোলন চলছে এবং চলমান থাকবে। নিরাপদ সড়কের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।”

বুধবার আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী একসঙ্গে হয়ে আন্দোলনে যোগ দেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন শিক্ষার্থদের এই প্রতিনিধি।  

“আজকে যারা আমরা এসেছি তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আরও বেশি একত্র করে আগামীকাল সকাল ১১টা থেকে রামপুরা ব্রিজের উপর থেকে আমাদের আন্দোলন শুরু করব।”

 

সড়কে অবস্থানের সময় তারা বিভিন্ন গাড়ি এবং চালকের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেন। লাইসেন্স কিংবা নিবন্ধন ছাড়া গাড়িগুলোকে আটক করে ট্রাফিক পুলিশকে জরিমানা আদায় করার জন্য বলেন।

রামপুরা পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য হেলালুর রহমান জানান, বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের গাড়ির কাগজপত্র না থাকায় এবং চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারণে জরিমানা করা হয়েছে।

“সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গাড়ি আটক করছে, তারা যেসব গাড়ির চালক ও কাগজপত্র আনছে সেগুলো পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

এ সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচয় দেওয়া একটি প্রাইভেটকারকে দেড় হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিমের প্রাইভেট কারও আটক করে শিক্ষার্থীরা।

তিনি এই গাড়িটি নিজে চালাচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ গাড়ির কোনো কাগজ নেই। পরে ছাত্ররা গাড়িটি আটক করে রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে নিয়ে আসে। এই গাড়িতে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া’ লিখে দেয়।

ঢাকার পরিবহন মালিকরা শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার দাবি মেনে নিলেও সারা দেশে গণপরিবহনে এই সুবিধা চালুর প্রজ্ঞাপনের দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকার নীলক্ষেতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

নীলক্ষেত মোড়ে দুপুর ১২টা থেকে সড়কে অবস্থান নেন ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ এবং বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ রাইফেলস কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঘণ্টাখানেক পর তারা ওই এলাকা ছেড়ে যায়।  

নীলক্ষেত ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পুলিশ সার্জেন্ট মোহাম্মদ আলী বলেন, “প্রায় একঘণ্টা এইখানে অবস্থান করে দুপুর ১টায় রাস্তা ছেড়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরের দিকে চলে যায়। এরপর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।”

ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে রাপা প্লাজার সামনে অবস্থান নেয় ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ, সেন্ট জোসেফ কলেজ, রাইফেলস পাবলিক কলেজসহ অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এসময় এম্বুলেন্স ছাড়া অন্যান্য সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একজন প্রতিনিধি নিরাপদ সড়কের দাবিতে হ্যান্ডমাইকে আবারও তাদের নয় দফা দাবি তুলে ধরেন।

ওই শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা এখন প্রজ্ঞাপন চাই। আমরা চাই আর কোনো মায়ের বুক খালি না হোক। গতকালকেও একজন শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল। তাকে কি জঘন্যভাবে মেরে ফেলা হয়েছে।

কালকে রাত থেকে আমরা কেউ খেতে পারিনি, ঘুমাতে পারিনি, পড়তে বসতে পারিনি। আমরা আমাদের স্কুলে, আমাদের কলেজে ফিরে যেতে চাই। আমরা রাস্তায় নামতে চাই না।”

তবে নিরাপদ সড়কের নয় দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছাড়েব না জানিয়ে, রাস্তায় বৈধ কাগজ ছাড়া যান চলাচল ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে শিক্ষার্থীদের এই জমায়েতে উপস্থিত হন ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার রুবাইয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে এখানে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছে। কিন্তু রাস্তা আটকে রাখায় দুইপাশ থেকেই গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।”

উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে শিক্ষার্থীরা ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর থেকে তাদের কর্মসূচি শেষ করে।