‘আমার পুতের জন্মদিন গো’: বিলাপ থামছে না মাঈনউদ্দিনের মায়ের

একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি দিয়ে কলেজে ভর্তির স্বপ্নে বিভোর ছিল ১৯ বছরের তরুণ মো. মাঈনউদ্দিন। সংসারে অভাব, তবু বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে আরও পড়াবেন; এখন তাদের পূর্ব রামপুরার বাসায় কেবলই বিলাপ।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2021, 04:26 AM
Updated : 30 Nov 2021, 04:53 PM

সোমবার রাত ১০টার দিকে ডিআইটি রোড পূর্ব রামপুরা লাজ ফার্মার সামনে গ্রিন অনাবিল পরিবহনের একটি বাসের চাপায় পিষে গেছে মাঈনউদ্দিনের জীবন, তার পরিবারের স্বপ্ন। 

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই এ ঘটনা ক্ষোভের আগুনে রসদ জুগিয়েছে। দুর্ঘটনার পর সেখানে অন্তত আটটি বাস পুড়িয়েছে ক্ষুব্ধ জনতা।

পূর্ব রামপুরার তিতাস রোডে মাইনউদ্দিনের দারিদ্র্যক্লিষ্ট ঘরে তখন শুধুই আহাজারি, কান্না থামাতে পারছিলেন না তার মা রাশেদা বেগম।

এক সাংবাদিক বয়স জানতে চাইলে রাশেদা বলছিলেন, ২০০২ সালের ২৯ নভেম্বর জন্ম নিয়েছিল তার ছোট ছেলে মাঈনউদ্দিন। সেই সংবাদকর্মী তখন বলেন, “আজই তো ২৯ নভেম্বর।”

কাঁদতে কাঁদতে মা বলতে থাকেন, “আমার পুতের জন্মদিন আইজকা, আমার মনে নাই গো। হেও জানতো না গো।… ২৯ নভেম্বর আমার পুতের জন্ম দিন গো। আজকে আমার বাবার জন্ম দিন গো।”

অনটনের সংসারে দুই ভাই আর এক বাক প্রতিবন্ধী বোনের মধ্যে মাঈনউদ্দিন ছিল সবার ছোট। বাবা আব্দুর রহমান ভাণ্ডারী তিতাস রোডে (মোল্লাবাড়ি) রাস্তার পাশে টং দোকানে চা-পান বিক্রি করেন। মাঈনউদ্দিনের বড় ভাই বনশ্রীর এক ব্যক্তির গাড়ি চালক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল সদরের আব্দুর রহমান জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন বছর পনের আগে। নানা কাজ করে তিনি সন্তানদের বড় করার চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু সংসারে অভাব ঘোচেনি।

একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া মাঈনউদ্দিন ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছার কথা বাবাকেও বলেছিল।

আব্দুর রহমান কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “আমার পুতে কইত- আব্বা আমারে একটা ভালো কলেজে ভর্তি করাইয়া দিও। আমার পুতেরে ভালো কলেজে ভর্তি কইরা দিমু। আমার পুতের কত আশা আকাঙ্ক্ষা… আমি কইছি আমার পুতেরে ভালো কলেজে ভর্তি কইরা দিমু।”

বাসের চাপায় ছেলে হারানো বাবা বলতে থাকেন, “মাইনু তাড়তাড়ি আসো, তোমারে বালা কলেজে ভর্তি করামু। তুমি না কইছ ভাল কলেজে ভর্তি করাইতাম? আইয়ু, তাড়তাড়ি আইয়ু, তোমারে বালা কলেজে ভর্তি করামু।”

শত অভাবের মধ্যেও ছেলের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যেতে গয়না আর জিনিসপত্রও বিক্রি করতে হয়েছে মা রাশেদা বেগমকে। মাইনুল বলত, বড় হয়ে সে মায়ের বিক্রি করা অলঙ্কারগুলো আবার কিনে দেবে।

“কত কষ্ট কইরা আমার পুতেরে লেহাপড়া করাইতাছি গো। হে পরীক্ষা দেয়, জিনিস বিচ্ছা বিচ্ছা জানুয়ারি মাসে ভর্তি করাই। আমি কই তোর জিনিস তো ভাগের তা শেষ! আমার আর কিচ্ছু নাই তোরে ভর্তি করাইতাম। হে কয়- মা আমি বড় হইয়া তোমারে বানাইয়া (অলঙ্কার) দিমু।”

রাশেদা জানান, পড়াশোনা শেষ করে সৎ পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখত মাঈনউদ্দিন।

“কইতাম- অ পুত, পুলিশে তো ঘুষ খায়, কয়- মা আমি ঘুষ খাইতাম না। অ নয়ন ডে, হে নয়ন। আর মাইনু মিছিলে যাইত না।”

গত সপ্তাহে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় এক করেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর থেকে রাজধানীতে আন্দোলন চলছে শিক্ষার্থীদের। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেই আন্দোলনে বন্ধুদের সঙ্গে মাঈনউদ্দিনও যেত।

তার মা বলেন, “স্কুলের পরীক্ষার শ্যাষ দিন বলতেছিল- মা আজকে মারামারি অইবো! আমি কই, বাবা মারামারি কইরো না, স্কুল থেইকা পরীক্ষা দিয়া বাসায় আইস্যা পড়বা।”

চায়ের দোকানে মাঝে-মাঝে বাবাকে সহযোগিতা করত মাঈনউদ্দিন। সোমবার রাতে দুর্ঘটনায় পড়ার কিছুক্ষণ আগেও সে বাবার সাথে দোকানের কাজে ছিল।

ঢাকার রামপুরায় সোমবার রাতে বিক্ষুব্ধ জনতার দেওয়া বাসের আগুন নেভানোর চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

আব্দুর রহমান ভাণ্ডারী বলেন, “আমার পোলা আমার সাথে বইয়া দোকানদারী করেছে। সুপারি কাটছে। সুপারি কাইট্ট্যা হাত ধুইছে, কইছে- আব্বা ১০টা ট্যাহা দেও, বুট খামু। এই খাইতো বের হইছে, এই ১০/১৫ মিনিট পরই আমার পুতে নাই হইয়া গেছে।”

মাঈনউদ্দিনের ভগ্নিপতির ভাই মো. বাদশা ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে মাঈনউদ্দিন ডিআইটি রোডের সোনালী ব্যাংকের সামনে দিয়ে সড়ক দিয়ে পার হচ্ছিল। তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।

“আমরা সেখানে গিয়ে শুনেছি, অনাবিল পরিবহন ও রাইদা পরিবহনের দুটো বাস পাল্লাপাল্লি করে যাচ্ছিল, সেই সময় তারা (মাঈনউদ্দিনরা) রাস্তা ক্রস করতেছিল। তারা হাত উড়িয়ে বাস থামাতে বললেও দুই বাসের মধ্যে পড়ে মাঈনউদ্দিনের শরীর চাকায় পিষ্ট হয়ে যায়।”

সে সময় মাঈনউদ্দিনের সাথে থাকা মোবাইল ফোন থেকেই ঘটনাস্থলের এক ব্যক্তি তার স্বজনদের খবর দেন।

বাদশা জানান, ফোন পেয়েই তারা ছুটে যান। পরে মাঈনউদ্দিনের খণ্ডবিখণ্ড দেহ বাসায় নিয়ে রাস্তার পাশে রাখেন। সেখান থেকে রাত ১২টার দিকে পুলিশ একটি ভ্যানে করে লাশ নিয়ে হাসপাতালের মর্গে চলে যায়।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের বাবা-মায়ের যে কষ্ট, সেই একই কষ্ট এখন রাশেদার বুকে।

তিনি বললেন, “গাড়ি কী খালি ছাত্ররারে এক্সিডেন করে? সরকারে কী করব! সরকারে কী করে? আল্লাহ আমার দুইডা পুত, তোমার হাতে মেহেরবান।”