সাত জেলা নিয়ে শঙ্কিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ‘লকডাউন’ চান

করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভারত সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করতে দেরি হলে সঙ্কট বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2021, 09:34 AM
Updated : 31 May 2021, 10:14 AM

সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

“মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এটা পর্যালাচনা করছে। আম চাষীদের অবস্থা বিবেচনা করে হয়ত দেরি করছে। আমরা চাই দ্রুত লকডাউন দেওয়া হোক প্রস্তাবিত জেলাগুলোয়।”

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “এটা (লকডাউনের সিদ্ধান্ত) কেবিনেট (ডিভিশন) করে। আমরা আলাপ করব যে উনারা কবে থেকে লকডাউন দেবেন। কিন্তু আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, যেসব জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, বেশি বেড়ে যাচ্ছে, সেখানে লকডাউন দিয়ে দেওয়া।”

তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, পুরো জেলা অবরুদ্ধ করা হবে, না জেলার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা- সেসব বিষয়ে ‘পরিস্থিতি বুঝে’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অবশ্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে স্থানীয় প্রশাসনও লকডাউনের ঘোষণা দিতে পারে, সেরকম নির্দেশনা আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

করোনাভাইরাসের ভারতে উদ্ভূত ধরনটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের প্রমাণ পাওয়ায় গত ২৪ মে থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউনের বিধিনিষেধ জারি করে জেলা প্রশাসন। সোমবার তা আরও এক সপ্তাহের জন্য বাড়ানো হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির বৈঠকে শনিবার সীমান্তের জেলাগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ঝুঁকি এড়াতে সীমান্তবর্তী আরও সাত জেলা অবরুদ্ধে ঘোষণার সুপারিশ করা হয় বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন।

এই সাত জেলা হল- নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও খুলনা। এসব জেলায় গত কিছুদিন ধরেই সংক্রমণ হার ঊর্ধ্বমুখী।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও ‘পরিস্থিতি বুঝে’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছিলেন।

সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, যশোর ও নাটোরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমরা চাইব যে জায়গাটিতে স্পেসিফিক্যালি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, সেই জায়গাটি শনাক্ত করতে। এমনও হতে পারে যে পুরো সাতক্ষীরা নয়, যে স্থানটিতে বেশি সংক্রমণ সেই জায়গাগুলোতে হয়ত (অবরুদ্ধ) করার চেষ্টা হবে, যাতে মানুষের জীবন জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সরকার সে বিষয়টি খেয়াল রাখছে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.এবিএম খুরশীদ আলম গত শুক্রবার জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের ভারতে উদ্ভূত ধরনটি পাওয়া গেছে, যারা কখনও প্রতিবেশী ওই দেশটিতে যাননি।

এর মানে হল, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক এই ধরনটির কমিউনিটি সংক্রমণ ঘটছে।

করোনাভাইরাসের এ ধরনটির আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.৬১৭। মিউটেশনের কারণে এর তিনটি ‘সাব টাইপ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া গেছে বি.১.৬১৭.২ ধরনটি।

ইতোমধ্যে অন্তত চার ডজন দেশে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক এ ধরনটি ছড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনটিকে চিহ্নিত করেছে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ (ভিওসি) হিসেবে।

রাজশাহী মেডিকেলে বেড়েছে কোভিড-১৯ রোগীর চাপ

দেরি কেন?

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে ‘লকডাউন’ দিতে দেরি করলে ঝুঁকি থেকেই যাবে। তবে এখন যেহেতু রাজশাহীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে আম ও লিচুর মৌসুম চলছে, সে কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে বলে তার ধারণা।

“সেখানে তিন চার হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। স্ট্রিক্ট লকডাউন দিলে চাষিরা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। এ দিকটাও তারা (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ) মাথায় নিয়ে কাজ করছেন।”

“কিন্তু আমাদের পরামর্শ হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লকডাউন দিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ এটা যেন সারাদেশে ছড়িয়ে না পড়ে,” বলেন জাহিদ মালেক।

পরে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকেও সাংবাদিকরা লকডাউনের সিদ্ধান্ত জানতে প্রশ্ন করেন।

উত্তরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সাত জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটি যে চিঠি দিয়েছে, তা তারা এখনও ‘হাতে পাননি;। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আগেই নির্দেশনা দেওয়া আছে, যাতে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা না হয়।  

“অলরেডি ডেপুটি কমিশনার (ডিসি), সিভিল সার্জন, চেয়ারম্যান বা মেয়র সাহেব; উনাদের বলেই দেওয়া আছে, যদি আপনারা মনে করেন যে কোনো জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ, সেক্ষেত্রে আপনাদের কমফোর্ট অনুযায়ী এটা করে দিতে পারবেন।

“ইচ্ছা করলে স্থানীয় জেলা প্রশাসন লকডাউন ঘোষণা করতে পারবেন- উনাদের আগেই বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন- চাঁপাইনবাবগঞ্জ, এটা কিন্তু ওখান থেকেই সাজেশন এসেছে।”

পুরো জেলা অবরুদ্ধ না করে বেশি সংক্রমণের এলাকাগুলোতে বিধিনিষেধ জারির কথাও ভাবা হচ্ছে জানিয়ে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “আমরা ডিস্ট্রিক্টগুলোতে বলে দিয়েছি, যদি মনে করে পুরো ডিস্ট্রিক্ট না করে ওই বর্ডার এলাকা লকডাউন করতে হবে, সেটাও বলে দেওয়া হয়েছে। যেভাবে উনারা সাজেশন দেবেন।

“পাশাপাশি এতদিন ধরে লকডাউন, নর্থ বেঙ্গল এখন আমের একটা মৌসুম। এই সময়ে যদি পুরোপুরি লকডাউন হয়, তখন কী হবে… এগুলো বিবেচনায় আছে। তবে যদি হার্মফুল মনে করি, তাহলে সেটা অবশ্যই…।”

এ বিষয়ে মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে সচিব বলেন, “কেবিনেট ওই কথাই বলেছে। একটা লকডাউন চলছে। আর যদি কোনো লোকাল জায়গায় কোনো রকম মনে হয়, যেমন- গতবছরও আমরা কোনো কোনো জায়গায় করেছি।”

সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কোভিড রোগীর চাপ বাড়তে থাকলেও হাসপাতাল ও চিকিৎসা অবকাঠামোর ঘাটতির বিষয়গুলো আসছে সংবাদমাধ্যমের খবরে।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “ইতোমধ্যে ডিজি হেলথকে বলা হয়েছে, যে সব জেলাগুলোর খারাপ অবস্থা, সেখানে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেন। আইসিইউর ব্যবস্থা এবং মেডিকেল কলেজগুলোর সিরিয়াস রোগীদের আগেই শিফট করার উদ্যেগ নেন।”

টিকা

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা কেনার জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া শেষের পথে।

“সেটা হলে জুন থেকেই ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা পাওয়া যাবে। এভাবে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা আসবে।”

বাংলাদেশ সরকারিভাবে সিনোফার্ম থেকে প্রতি ডোজ ১০ ডলার দরে দেড় কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনবে। জুন থেকে তিন মাসে ওই টিকা বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, টিকা এলে সরকার প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, যাতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায়।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই টিকা দেওয়ার চেষ্টা করব। আমরা চাই টিকা নিয়ে তারা লেখাপড়া শুরু করুক। ফাইজারের টিকার ক্ষেত্রেও আমরা শিক্ষার্থীদের একটু অগ্রাধিকার দেব।”