নির্যাতনের অভিযোগে মামলার আবেদন কার্টুনিস্ট কিশোরের

ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থানায় গ্রেপ্তার দেখানোর আগে ‘অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন’ চালানোর অভিযোগে ‘হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ’ আইনে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2021, 11:16 AM
Updated : 10 March 2021, 12:59 PM

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া কিশোর বুধবার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে এ মামলার আবেদন করেন।

এ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাপস পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ বাদীর জবানবন্দি শুনেছেন। এ বিষয়ে তিনি পরে আদেশ দেবেন।”

মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, গতবছরের ৫মে রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিন্তু তারও তিন দিন আগে ২ মে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে সাধারণ পোশাকের ১৬-১৭ জন লোক কাকরাইলের বাসা থেকে তাকে ‘জোর করে হাতকড়া ও মুখে মুখোশ পরিয়ে অজ্ঞাত এক নির্জন জায়গায়’ নিয়ে যায়।

ওই তিন দিন তাকে সেখানে ‘নির্যাতন’ করা হয় অভিযোগ করে তার বিস্তারিত বিবরণও মামলার আর্জিতে তুলে ধরেছেন কিশোর।

সেখানে বলা হয়েছে, গত বছরের ২ মে সন্ধ্যার দিকে কলিং বেলের শব্দে কিশোরের ঘুম ভাঙে। দরজা খুলতেই অপরিচিত এক লোক বলেন, ‘দরজা খোলেন না কেন? পরনের লুঙ্গি পরিবর্তন করে প্যান্ট পরে নেন। সাথে একটা ভালো শার্ট।’

কিশোর পরিচয় জিজ্ঞেস করলেও তারা পরিচয় দেননি; তবে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় তাদের একজনকে ‘জসিম’ নামে ডাকতে শোনার কথা কিশোর তার আর্জিতে লিখেছেন।

সেখানে বলা হয়েছে, অপরিচিত ওই লোকেরা ঘরে ঢুকে তল্লাশি শুরু করে। অথচ কোনো ধরনের পরোয়ানা তারা দেখাতে পারেনি

কিশোরের বাসা থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, কম্পিউটার সিপিইউ, পোর্টেবল হার্ড ডিস্কসহ ডিজিটাল যত ডিভাইস ছিল, সবই তারা নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন কিশোর।

আর্জিতে বলা হয়েছে, কিশোরকে যখন হাতকড়া পরিয়ে বাসার নিচে নামিয়ে আনা হয়, তখন সেখানে ছয়-সাতটি গাড়ি অপক্ষো করছিল। তাকে একটি গাড়িতে তোলার সময় বাসার সামনে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিল। গাড়িতে তোলার পর কিশোর চিৎকার শুরু করলে সেই শব্দ চাপা দিতে জোরে গান বাজানো হয়, যাতে চিৎকারের শব্দ বাইরে না যায়। 

কিশোর বলছেন, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি পুরানো ও স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ির একটি কক্ষে। সেখান থেকে তিনি বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দ পাচ্ছিলেন।

মামলার আর্জিতে বলা হয়, ওই ঘরে প্রজেক্টরের মাধ্যমে কিশোরের নিজের আঁকা বিভিন্ন কাটুর্ন একের পর এক দেখিয়ে সেগুলোর মমার্থ জানতে চাওয়া হয়। করোনাভাইরাস নিয়ে আঁকা কিছু কার্টুন দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয়, তিনি সেগুলো কেন এঁকেছেন; কার্টুনের চরিত্রগুলো  কারা।

কিশোর বলেছেন, এক পর্যায়ে ‘প্রচণ্ড জোরে থাপ্পর মারা হয়’ তার কানে। তাতে কিছু সময়ের জন্য বোধশক্তিহীন হয়ে পড়েন। তবে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পরে ‘স্টিলের পাত বসানো লাঠি দিয়ে’ তাকে ‘পেটানো’ হয়। যন্ত্রণা ও ব্যথায় তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।

সেখানে ২ মে থেকে ৪ মে এভাবে তার ওপর ‘শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার’ চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন কিশোর। আর্জিতে তিনি বলেছেন, পরে তিনি নিজেকে র‌্যাব কার্যালয়ে দেখতে পান। সেখানে তার সঙ্গে লেখক মুশতাক আহমেদের দেখা হয়। মুশতাকের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারেন, মুশতাককে ‘বৈদ্যুতিক শক’ দেওয়া হয়ছে।

৬ মে রমনা থানায় হস্তান্তর করার পর ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয় তাদের বিরুদ্ধে।

মুশতাক আহমেদ

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার এসআই জামশেদুল ইসলাম তখন বলেছিলেন, কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ নামের ফেইসবুক একাউন্টে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন-পোস্টার পোস্ট করতেন। আর মুশতাক তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেন।

র‌্যাব-৩ এর ডিএডি আবু বকর সিদ্দিকের করা ওই মামলায় রাষ্ট্রচিন্তার সংগঠন দিদারুল ভূইয়া এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে এ দুজন জামিনে মুক্তি পান। মুশতাক ও কিশোরের পক্ষে বেশ কয়েকবার জামিনের আবেদন হলেও তা আদালতে নামঞ্জুর হয়।

এই মামলায় আসামির তালিকায় মুশতাক, কিশোর, দিদার, মিনহাজের সঙ্গে আরও ছিলেন নেত্র নিউজের সম্পাদক সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিল, জার্মানিতে থাকা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম, হাঙ্গেরি প্রবাসী জুলকারনাইন সায়ের খান (আল জাজিরার প্রতিবেদনের স্যামি), আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখার।

তবে তদন্তের পর শুধু মুশতাক, কিশোর ও দিদারকে আসামি করে গত জানুয়ারিতে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় রমনা থানা পুলিশ। বাকি আট আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন এ মামলায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।

সেই দায়িত্ব পাওয়ার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপপরিদর্শক ও মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আফছর আহমেদ আসামি কিশোর ও মুশতাককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছিলেন।

কিন্তু সেই শুনানি হওয়ার আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুশতাকের মৃত্যু হয়। আর হাই কোর্ট থেকে গত ৩ মার্চ ছয় মাসের জামিন পাওয়া কিশোর পরদিন কারামুক্ত হন।   

মুশতাকের মৃত্যুতে প্রতিবাদ শুরু হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি নতুন করে জোরালো হয়ে ওঠে। কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

এদিকে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পরপরই একটি হাসপাতালে ভর্তি হন কিশোর। এখনও তিনি শরীরিকভাবে অসুস্থ, কান দিয়ে পুঁজ পড়ে, ঠিকমত হাঁটতে পারেন না। হঠাৎ করে পড়ে যান, শরীরে নানা রকম রোগের উপসর্গও দেখা যাচ্ছে।

চার পৃষ্ঠার আরজির শেষ অংশে কিশোর ২০১৩ সালের ‘নির্যাতন এবং হেফাজেতে মৃত্যু (নিবারণ)’ আইনের ৪/৫/৬/৭/ ধারায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিতে প্রার্থনা জানিয়েছেন আদালতের কাছে।

এ সময় কিশোরের সঙ্গে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন রিপন বড়ুয়া।