অহরহ ছিনতাই হলেও টাকা বহনে পুলিশি নিরাপত্তায় আগ্রহ কম

ঢাকা শহরে বড় অংকের টাকা আনা-নেওয়ার পথে ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয়ে থাকে, এ ধরনের ঘটনা রোধে বিনা খরচে পুলিশ নিরাপত্তা দিতে চাইলেও তাতে সাড়া মিলছে না।

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2021, 05:03 AM
Updated : 22 Jan 2021, 05:03 AM

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণের এ সেবা নিতে আগ্রহ কম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই টাকা বহনের এই সেবা নিলে রাস্তাঘাটে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত না।

সাধারণ ব্যবসায়ী, ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিজেরাই মোটা অংকের টাকা বহন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত খোয়াতে হচ্ছে সেই টাকা, এমনকি টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় আহতও হতে হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটছে খুনের ঘটনা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিদিন জনসাধারণের ‘মানি এসকর্টের’ জন্য ১০টি দল গঠন করা রয়েছে।

রমনা, মতিঝিল, ওয়ারি ও লালবাগ বিভাগে সেবা প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে মানি এসকর্ট সহায়তা দিতে আব্দুল গণি রোডের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে পাঁচটি টিম এবং মিরপুর, গুলশান, উত্তরা ও তেজগাঁও বিভাগে এ সেবা দিকে মিরপুর পুলিশ কন্ট্রোল রুমে পাঁচটি টিম সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

সেবা প্রত্যাশীদের ৯৫৫৯৯৩৩, ৯৫৫১১৮৮, ৯৫১৪৪০০ ও ০১৭১৩-৩৯৮৩১১ নম্বরে ফোন করতে বলা হয়েছে।

স্থানীয় থানা এবং ডিএমপি সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে পুলিশ এসকর্ট সেবাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারণাও রয়েছে।

গত বছর ১৭ মে টাঙ্গাইলের কালিহাতির একটি পোস্ট অফিস থেকে গ্রাহকদের সঞ্চয়পত্র ও এফডিআরের ৫০ লাখ টাকা তুলে নিজের গন্তব্যস্থল একটি সাব পোস্ট অফিসে যাওয়ার পথে তাকে গুলি করে টাকাগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

তবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ ‘মানি এসকর্ট’ নিতে তেমন আগ্রহ দেখান না। নিজেরাই লাখ লাখ টাকা এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে এবং এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বহন করছেন। সেই ফাঁকে ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।

পুরান ঢাকার কোতয়ালী থানার ওসি মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাদামতলী, ইসলামপুর ও বাবুবাজারে অসংখ্য ব্যবসায়ী রয়েছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া আর কেউ পুলিশের মানি এসকর্ট সেবা নেয় না।

বংশাল থানার ওসি শাহীন ফকির বলেন, প্রতিদিন সকালে এসে তার থানা এলাকায় যত ব্যাংক রয়েছে সেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পুলিশের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে জানানোর অনুরোধ করেন।

“এলাকার ব্যবসায়ীদেরও বলা হয়, কিন্তু এসকর্ট নিয়ে তেমন সাড়া পাচ্ছি না। মাসে বড়জোর চার থেকে পাঁচজন মানি এসকর্ট নেয়। অথচ এলাকায় বহু ব্যবসায়ী টাকা বহন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় বা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকে যায়।”

ভাষানটেক থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন বলেন, “ঈদের সময় কিছু মানি এসকর্ট দেওয়া হয়, কিন্তু অন্যান্য সময় তেমন সাড়া নেই।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের  উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পুলিশ সব সময় জনগণের নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। টাকা বহনের ক্ষেত্রে তো সঙ্গে সঙ্গে টিম পাঠানো হয়।

“কিন্তু তারপরেও মানুষ টাকা এসকর্ট নিতে চায় না। কারণ সব টাকাই টাকা (হুন্ডি) নয়। তাই সবাই সহযোগিতা নিতে চায় না।”

আর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোটি টাকা বহনের প্রশ্ন এলে মানুষ পুলিশের সহযোগিতা নেয়। লাখ লাখ টাকার ক্ষেত্রে তারা এ বিষয়ে চিন্তা করে না। সাধারণত পোশাক কারখানার মালিকদের অনেকে মোটা অংকের টাকা বহনের ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে থাকে।

নিয়মিত ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা

মানুষ পুলিশের নিরাপত্তা সেবা নিতে অনীহা দেখালেও ছিনতাই, টাকা লোপাটসহ দুর্ঘটনা কিন্তু বন্ধ নেই। 

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার সাভারে দিনের বেলায় এক ইতালি প্রবাসীকে গুলি করে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা।

গত বছরের ১০ মে পুরান ঢাকার বিভিন্ন শাখা থেকে উত্তোলন করা ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮০ লাখ টাকার একটি বস্তা গাড়ি থেকে খোয়া যায়। দিনে দুপুরে ঘটে যাওয়া ওই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করে ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

পরে কয়েক দিনের মধ্যে ৬০ লাখ টাকা উদ্ধার এবং বিদেশি অস্ত্রসহ ওই টাকা লুটে নেওয়া চারজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

ওই বছর একই দিন দুপুরে যাত্রবাড়ীর জনপদ মোড়ে ৫৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সাইফুল ইসলাম সবুজ (৩৫) ও রফিকুল ইসলাম মুকুল (৩০) যাত্রাবাড়ীর কাজলায় তাদের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট অফিস চালাতেন। দুই ভাই একটি মোটরসাইকেল করে ব্যাংকের ৫৫ লাখ টাকা নিয়ে মতিঝিলে ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় জমা দেওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন। তাদের মোটরসাইকেলটি জনপদ মোড়ে এলে সেখানে তিন মোটরসাইকেলে ছয়জন ছিনতাইকারী তাদের গতিরোধ করে এবং মোটরসাইকেল ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পরে তাদেরকে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ৫৫ লাখ টাকার ব্যাগ নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা ফাঁকা গুলি করে সন্ত্রাসীরা।

একই দিন খিলগাঁওয়ে দিনদুপুরে গুলি চালিয়ে ২০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। গোরান বাজারের একতা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের কর্মচারী আব্দুস সালাম (৩০) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঢাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার উদ্দেশে বের হন। পথে সন্ত্রাসীরা তার গতিরোধ করে পরপর চার রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। দুটি গুলি আব্দুস সালামের বাম পায়ে বিদ্ধ হয়। দুর্বৃত্তরা টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন সালামকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন।

এরপর গত বছর ৭ জুন গাজীপুরে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার পথে একটি পোশাক কারখানার ৮২ লাখ ১২ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার বাবুবাজারে কুষ্টিয়ার এক চাল ব্যবসায়ীকে গুলি করে অর্ধ কোটি টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা, পরে ওই ব্যবসায়ী মারা যান।

২০১১ সালের ৮ অগাস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে মাস্টার্স গার্মেন্টসের প্রধান হিসাবরক্ষক খাইরুলকে গুলি করে ৪০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।

২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল পুরান ঢাকার নবাববাড়ি এলাকায় এক ফল ব্যবসায়ীকে গুলি করে ১৬ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

একই বছরের ২৫ মে রাজধানীর মগবাজারে দিনে-দুপুরে ওষুধ কোম্পানির ৩৩ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওষুধ কোম্পানি সানোফি ফার্মার হিসাব রক্ষক সেলিম আকতার অফিস থেকে নগদ টাকা একটি ব্যাগে ভরে হেঁটে কাছের ব্র্যাক ব্যাংকে যাচ্ছিলেন, মগবাজারের বিশাল সেন্টারের সামনে তার পথ রোধ করে মোটরসাইকেলে এসে তাকে গুলি করে ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

এরপর ২০১৬ সালের ৫ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ-এর এজেন্ট সাইদুর রহমানকে গুলি করে ১৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠে।

ওই বছর ২০ অগাস্ট রাজধানীর ভাটারার নুরেরচালা এলাকায় জহিরুল ইসলাম জহির (২৪) নামে একজন বিকাশ এজেন্টকে গুলি করে ৫ লক্ষাধিক টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।

২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল কাফরুলের শেওড়াপাড়া এলাকায় ছিনতাইকারীরা আল আমিন নামে এক বিকাশকর্মীকে গুলি করে তিন লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।

যা বলছেন ব্যবসায়ীরা

এত এত দুর্ঘটনার পরেও টাকা বহনের জন্য কেন পুলিশের নিরাপত্তা নেওয়া হয় না, সে বিষয়ে নিজেদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের তেল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টাকা পরিবহন করতে পুলিশের সহযোগিতা চাই না, নিজেই টাকা ব্যাংকে বা অন্যান্য দোকানে দিয়ে আসি।

“সহযোগিতা চাইলে পুলিশ বলবে, এত টাকা কোথায় পেলেন? নানা প্রশ্ন করবে তাই এ ঝামেলায় জড়াতে চাই না।”

সাইফুলের মতো পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর কাপড় ব্যবসায়ী মামুনও একই কথা বলেন।

গত বছর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে টাকা খোয়ানোর পর তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পুলিশের সহযোগিতা নেননি কেন?

জবাবে তিনি বলেছিলেন, “প্রতিনিয়ত টাকা আসছে আর ব্যাংকে জমা দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং বার বার কী আর পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া যায়?” 

তবে চকবাজার থানার ওসি মওদুত হওলাদার বলেন, তার এলাকায় ৫৪টি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকে প্রতিদিন শত কোটি টাকা লেনদেন হলেও টাকা পরিবহনে পুলিশের সহযোগিতা তেমন চাওয়া হয় না। যে কয়েকবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে প্রতিবারই এসকর্ট দেওয়া হয়েছে।

“পুলিশ কখনও টাকার উৎস বা অন্য কিছু জানতে চায় না। শুধু নিরাপত্তা দিয়ে থাকে,” বলেন তিনি।

ব্যবসায়ীর বাসায় রাত কাটাল পুলিশ

বড় অংকের টাকার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বাড়ির সদস্য বেশে দুই পুলিশ সদস্য গুলশান এলাকায় এক পোশাক ব্যবসায়ীর বাসায় রাত কাটিয়েছেন।

কয়েক মাস আগে এই ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানান গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক ব্যবসায়ীর গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানা রয়েছে। ব্যাংক থেকে সাড়ে ৬ কোটি টাকা তোলার পর সন্ধ্যা হয়ে যায় এবং ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার।

পরদিন শুক্রবার হওয়ায় পুলিশ পাহারায় টাকা গাজীপুর নেওয়া হলেও তিনি শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবেন না।

“কী করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। ওই ব্যবসায়ীকে বলা হল, আপনি চাইলে দুজন পুলিশ সদস্য আপনার বাসায় রাতে দেওয়া হবে। কিন্তু ব্যবসায়ী বললেন, পোশাকে পুলিশ থাকলে ভবনের এবং আশপাশের মানুষ সন্দেহ করবে এবং অন্য কিছু ভাববে।

“তাই সাদা পোশাকে ওই ভবনের বাসিন্দাদের মতো দুজন পুলিশ সদস্য দুই রাত ওই টাকা পাহারা দিয়েছেন।”

পরে কারখানা খোলার পর এসকর্ট করে ওই টাকা গাজীপুরে নেওয়া হয়।

বিনা সংকোচে টাকার নিরাপত্তায় পুলিশের সহযোগিতা চাইতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।