ধর্ষণ: বিচার পেতেও বাধা পদে পদে

সামাজিক হেনস্তার ভয় কাটিয়ে ধর্ষণের বিচারের চাইতে দাঁড়ালেও পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয় নারীদের।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস জয়ন্ত সাহা ও রাসেল সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2020, 05:45 PM
Updated : 22 Oct 2020, 05:45 PM

এক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গীর পাশাপাশি প্রভাবশালীদের চাপ, আইনের ফাঁক, মামলার দীর্ঘসূত্রতাকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী ধর্ষণের মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ক্ষেত্রে তা হয় না।

সাক্ষী না পাওয়া, শারীরিক আলামত অনেক সময় না পাওয়া অভিযুক্তকে বাঁচিয়ে দেয় বলে আইনজীবীরা বলছেন।

প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারায় ধর্ষিত নারীকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করার সুযোগ থাকায় এটাকেও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখছেন অধিকারকর্মীরা।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সিলেট ও নোয়াখালীর দুটি ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি করেছে। ধর্ষণের বিচার দাবিতে আন্দোলনও চলছে।

আন্দোলনের মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির মাত্রা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড করেছে।

তবে সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার উপরই বেশি জোর দিচ্ছেন আইনজ্ঞরা।

দেড় লাখের বেশি মামলা

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৫১টি মামলা নিয়ে ২০১৯ সালের যাত্রা শুরু হয়।

বছর শেষে এ অপরাধের মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ২৪ হাজার ৯৫১টিতে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৫৪ হাজার ৬১৮টি মামলা। আর নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে মামলা স্থানান্তর হয় আরও ১৯৪০টি।

বছর শেষে দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৯৩টি।

সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ হাজার ৫৩৯টি। আর উচ্চ বা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত মামলার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৭৫টি।    

মামলার পরিসংখ্যান নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে মেট্রোপলিটন এলাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যে বিচারগুলো হয়, সেখানে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ মামলায় চূড়ান্ত রায় হয়।

বিচার শেষ হয় না নির্ধারিত সময়ে

ধর্ষণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়ার এবং বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তা হয় না।

আইনজীবীরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করে হাইকোর্টকে অবহিত করার বিধান থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না।

সাক্ষী হাজির করতে না পারায় মামলার তারিখ বারবার পেছায় বলে জানান আইনজীবীরা।

ঢাকার আইনজীবী আরফান উদ্দিন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, আইনে ধর্ষণ মামলার কন্টিনিউয়াস ট্রায়ালের কথা থাকলেও আপস ও অন্যান্য কারণে তা অব্যাহত রাখা যায় না।”

তিনি জানান, অনেক সময় আসামি পক্ষের তদবিরে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের পাঠানো সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আটকে থাকে। বাদীর ব্যক্তিগত আইনজীবীদের গাফিলতিতেও অনেক সময় মামলার বিচার দীর্ঘায়িত হয়।

আরফান বলেন, “যেহেতু ধর্ষণ মামলার ভিকটিম অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরিব হন, সেক্ষেত্রে আদালতের সংশ্লিষ্ট খরচ, সাক্ষীদের রাহা খরচ ও আইনজীবীর ফি আনতে পারেন না। ফলে সাক্ষ্যও আর এগোয় না, বিচার ঝুলে থাকে।”

যে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেজন্য তাকেই আবার দোষারোপ করছে এ সমাজের কেউ কেউ। দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপীড়নের সেই বাস্তবতা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সাক্ষীর আসতে অনীহার বিষয়ে তিনি বলেন, “বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় ক্যামেরা ট্রায়াল বা রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার না হওয়ায় ভিকটিম বা বাদী পক্ষ আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে ভয় ও লজ্জা পান।

“অনেক ক্ষেত্রেই আসামি পক্ষের আইনজীবীরা ভিকটিমসহ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরার সময় অশ্লীল ও অভব্য প্রশ্ন করেন। এসব কারণে সাক্ষ্য দিতে তারা অনীহা প্রকাশ করেন।”

প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় ধর্ষিত নারীকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করার বিধান থাকাটা কতটা ন্যায়সঙ্গত, তা ভাবা এখন প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে।

ঢাকার আরেক আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ধর্ষণ মামলাসহ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষের বিধান থাকলেও তা বাধ্যতামূলক নয় বরং ডাইরেক্টরি।

“বিচারে দেরি হওয়ার মূল কারণ হল রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষী আনতে পারে না। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, পুলিশের অবহেলা ও দুর্নীতি এখানে কারণ হিসাবে কাজ করে। অনেক সময়ে তারা আসামিদের পক্ষে কাজ করে।”

পাশাপাশি বিচারক আন্তরিক হলে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত এগোতে পারে বলে মন্তব্য করেন টিটো।

ঢাকার মহানগর জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, মামলা ঝুলে থাকায় অনেক সময় বাদী-বিবাদী আপস করে ফেলেন।

নির্যাতন ও ধর্ষণে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ সব ধর্ষণের বিচার নিশ্চিতের দাবি আন্দোলনকারীদের। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সমস্যা যখন আলামত

ধর্ষণের ঘটনায় সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য শারীরিক আলামত ও চিকিৎসা সনদপত্র। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রমাণ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না।

নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আইনজীবী মাহমুদা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক সময় ধর্ষণের চিহ্ন তাৎক্ষণিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। ডিএনএ টেস্টও করা হয় না, যেটি আসলে খুব জরুরি। সেজন্য তদন্ত প্রক্রিয়া ধীর গতির হয়।”

এসব মামলার আইনজীবীরা বলছেন, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনার পর আলামত না পাওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা তা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠাতে পারেন না।

আমিনুল গণী টিটো বলেন, শুধু গতানুগতিক মেডিকেল পরীক্ষা দিয়ে ধর্ষণ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিলে চলবে না।

“চিকিৎসক, তদন্ত কর্মকর্তা, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সবাই সততার সঙ্গে কাজ না করলে ধর্ষণের সত্য মামলাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।”

ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধর্ষণের মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষাটা লাগবেই। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না।”

অধিকার কর্মী খুশি কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলার কোনো একটি প্রমাণ যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে বিচারকের রায় দিতে কিন্তু সমস্যা হবে।”

ধর্ষণের প্রতিবাদ ভাষা পেয়েছে গ্রাফিতিতে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

চাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত বিচার

ধর্ষণের আসামিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হওয়ায় অভিযোগকারী নিরাপত্তার প্রশ্নটি চলে আসে।

অধিকার কর্মী খুশি কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মধ্যেই দুর্বলতা আছে। ধর্ষণের সংজ্ঞা স্পষ্ট নয়। তারপর আসে ভিকটিমের নিরাপত্তা।

“যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করা দরকার। কেউ ধর্ষিত হলে সবার আগে তার চরিত্র নিয়েই কথা হয়। বলা হয়, তার সব শেষ হয়ে গেল। এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার যে প্রশ্ন, সেটাও কিন্তু সঠিকভাবে হয়নি। সেটাও নিশ্চিৎ করতে হবে।”

ধর্ষণের নতুন ও পুরনো মামলাগুলোর বিচার ত্বরান্বিত করতে আইনের কাঠামোর পরিবর্তনের পাশাপাশি পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের পক্ষে মত জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দণ্ডাদেশ আসবে। এই দীর্ঘসূত্রতা রক্ষা করে বিচার পাওয়াটা অত্যন্ত জটিল। সেই জায়গায় রাষ্ট্রকে অবশ্যই নারীবান্ধব হতে হবে। পৃথক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করতে হবে।”