সেই সঙ্গে বিচার না হওয়ার যে ‘সংস্কৃতি’ তৈরি হয়েছে, সেটাও অপরাধ বাড়িয়ে তুলছে বলে তাদের অভিমত।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ফৌজদারি অপরাধের অস্বচ্ছ ও বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়াও ধর্ষণ বাড়ার অন্যতম কারণ।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সিলেট ও নোয়াখালীর দুটি ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি করেছে। ধর্ষণের বিচার দাবিতে আন্দোলনও চলছে।
আন্দোলনের মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির মাত্রা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ডে নিয়েছে।
তবে একই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠেছে- শুধু মৃত্যুদণ্ড দিয়েই কি এ অপরাধ দমন করা সম্ভব?
ধর্ষণ এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, দেশে ২০১৭-২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯-২০২০ সালে ধর্ষণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
২০১৬ সালে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৭২৪টি, ২০১৭ সালে ৮১৮ট, ২০১৮ সালে ৭৩২টি, ২০১৯ সালে ১৪১৩টি এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫টি।
যেসব ঘটনায় অভিযোগ করা হয়, সেগুলোই হিসেবের মধ্যে আসে। ফলে অনেক ঘটনা রয়ে যায় আড়ালে।
এর উদাহরণ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের নির্যাতিত সেই গৃহবধূই; তিনি বলেছেন, তিনি তার আগে ধর্ষণের শিকার হলেও বিচার চাওয়ার সাহস পাননি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে মেয়েশিশুরা।
তাদের পরিসংখ্যান বলছে, গত সেপ্টেম্বরে ৩৪০টি নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৩টি। আর ৩৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয় ১০ শিশু ও ১০ নারীকে।
মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অগাস্টে নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের হার কিছু কম ছিল।
অগাস্টে ২৪৯টি নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৯টি, নারী ধর্ষণ হয়েছেন ২৩ জন। আর দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয় ১৪ শিশু ও ১৮ জন নারীকে।
আর জুলাইয়ে ২৩৫টি নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে মহিলা পরিষদ। এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬৮টি, নারী ধর্ষণের ঘটনা ২২টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনায় ৭১৯টিতে মামলা হয়েছে।
এই সময়ে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৩টি। দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২০৮টি। ধর্ষণের শিকার ১২ জন আত্মহত্যা করেছেন।
ধর্ষিত ৯৭৫ জনের মধ্যে ১৪০ জনের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের উপর ৫২টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
‘ঘুন ধরেছে সমাজে-রাষ্ট্রে’
ইদানিং ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই মুহুর্তে ধর্ষণ বাড়ার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকে কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি।
“ফলে এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা যার বা যাদের মধ্যে আছে, তারা সে দুর্বলতাকে ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। প্রকারান্তরে তা এই মনস্তত্ত্বকেই উৎসাহিত করছে, ধর্ষকামী করে তুলছে।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “সমাজের যে প্রাতিষ্ঠানিক নিবেদন ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেমন পরিবার, প্রতিবেশী, এলাকাভিত্তিক সংগঠন এগুলো নানাভাবে আমাদের সংযত হতে শিখিয়েছে, মানবিক হতে শিখিয়েছে।
“এখন তথাকথিত সামাজিক রূপান্তর এবং উন্নয়ন আধুনিকতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এই বন্ধনগুলো ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে। পাশ্চাত্যেও এমনটা হয়েছে। একদিকে আমাদের সামাজিক অনুশাসনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে এই জিনিসগুলো পেয়ে আমরা বেপরোয়া হয়ে উঠছি।”
সমাজের এই অস্থির পরিস্থিতিকে জিয়া রহমান ব্যাখ্যা করেন আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম অগবার্নের তত্ত্ব দিয়ে। পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার সামাজিক রূপান্তর নিয়ে তত্ত্ব দিয়েছিলেন উইলিয়াম অগবার্ন, যেটি ‘কালচারাল লেক’ (সাংস্কৃতিক অসঙ্গতি) নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
জিয়া রহমান বলেন, “অগবার্নের মতে, যখনই কোনো নতুন প্রযুক্তি সমাজে আসে মানুষ তখন খুব সহজেই এটা গ্রহণ করে থাকে। তিনি এটাকে বলেছেন ম্যাটারিয়াল কালচার (বৈষয়িক সংস্কৃতি)। সমাজ পরিবর্তনের সময় প্রযুক্তি বা বৈষয়িক সাংস্কৃতিক উপাদান যত সহজে আমরা গ্রহণ করি, তার সাথে অবৈষয়িক বা ভাবগত সংস্কৃতি- আদর্শ, মূল্যবোধ, নিয়ম,নীতি-নৈতিকতা তেমনভাবে গ্রহণ করি না।
“ফলে প্রযুক্তি বা বৈষয়িক সংস্কৃতি কতটুকু কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেটা আমরা জানি না। ফলে আমরা বেপরোয়া, উন্মত্ত হয়ে উঠি। অপরাধ বাড়তে থাকে। আর অবাধ প্রযুক্তি, মাদক, পর্নগ্রাফির কারণে একজন পুরুষ তার যৌন প্রবৃত্তিটাকে বেপারোয়াভাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে বলেই ধর্ষণসহ অপরাপর অপরাধ বাড়ছে।”
রাষ্ট্রের দুর্বলতা তুলে ধরতে গিয়ে বিদ্যমান ফৌজদারি অপরাধের বিচার কাঠামোকে দায়ী করেন অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক জিয়া।
তিনি বলেন, “আমাদের ফৌজদারি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা রয়ে গেছে। ফৌজদারী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া যেমন পুলিশ, আদালত, প্রসিকিউশন ও কারাগার এই চারটির মধ্যেই পুরুষতান্ত্রিক, সামন্ততান্ত্রিক, উপনিবেশিক উপাদান বজায় আছে।
“এই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাবানদের সেবা করার ক্ষেত্রে কাজ করছে। সাধারণ মানুষ বা অপরাধের শিকার ব্যক্তিকে সেবা না দেওয়ার মনোভাব তৈরি হয়েছে। ফলে একজন ভিকটিমকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তার কিছুই এ রাষ্ট্রে নেওয়া হয় না।”
সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীর প্রতি যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করা হয়, তাও ধর্ষণ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দেয় বলে মনে করেন মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সমাজে ধর্ষিত নারীকেই দোষারোপ করা হয়। তার চালচলনকে দায় দেওয়া হয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নানাভাবে নারীকে হেয় করে বক্তব্য দেওয়া হয়। সমাজে নারীবিরোধী প্রচারণা…..
“আসলে আমরা তো পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠছি না। যুব শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বিষয়কে জনগুরুত্বপূর্ণ বলে সামনে আনতে হবে। শুধু আইন ঘোষণা করে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না।”
আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মাদকের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইদানিং কিন্তু গ্যাংরেপ বেড়েছে। আগে এতটা দেখি নাই। এর সাথে মাদকের একটা যোগাযোগ আছে। বিশেষ করে সাইকেডেলিক ড্রাগ যেগুলো। এগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নাই। যে কারণে গণধর্ষণ বেড়েছে বলে মনে হয়।
“ইয়াবাসহ যেসব মাদকের কথা আমরা শুনি এগুলো কিন্তু যৌন উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। আমি অনেক সময় পুলিশকে ফোন করে জেনেছি ধর্ষক ইয়াবা আসক্ত।”
‘বিলম্বিত বিচারে আইন হারায় প্রভাব’
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু মনে করেন, ধর্ষণ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সমাজে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না।
রাজনৈতিক প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় অপরাধীরা দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসার কথাও বলেন তিনি।
“অপরাধীরা যে কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় বা প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বের হয়ে আসছে। বের হয়ে গিয়ে তারা কিন্তু বেপরোয়া হয়ে উঠছে।”
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলেই হবে না, ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের মামলাগুলো সুষ্ঠু-স্বচ্ছভাবে দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে পারলে এ অপরাধের হার কমে আসবে বলে মনে করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রথম নারী বিচারক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচারটা করতে হবে তাড়াতাড়ি। বিচারটা যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ঝুলিয়ে রাখলে হবে না।”
‘মৃত্যুদণ্ডই সমাধান না’
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এই অপরাধ কমার আশা করলেও তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন আইনজ্ঞরা।
মৃত্যুদণ্ডের সাজার চেয়ে বিচার সুষ্ঠুভাবে দ্রুত করার উপরই জোর দিচ্ছেন বিচারপতি নাজমুন আরা।
তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় কিছুটা ভয় তো পাবেই। তবে ধর্ষণের সময় একজন ধর্ষক তো আর শাস্তির কথা চিন্তা করে ধর্ষণ করে না, এটাও আমাদের ভাবতে হবে। খালি শাস্তি বাড়লেই হবে না। বিচার প্রক্রিয়া যাতে সুষ্ঠুভাবে তাড়াতাড়ি হয় সেটা দেখতে হবে।”
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় এখন ধর্ষণের পর ধর্ষণকারী আলামত গোপনে ধর্ষিতকে মেরে ফেলার দিকে ঝুঁকতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।
আইনি কাঠামোর সংস্কার না করলে সমাধান আসবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল।
তিনি বলেন, “ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে, তাতে আমরা একটা জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
“বৈশ্বিক পরিসংখ্যান যেটা বলে, তা হল- সাধারণত যেসব অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় পৃথিবীর কোনো দেশেই সে অপরাধগুলো কমেনি। হতে পারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার কারণে ধর্ষণ কিছুটা কমে আসবে। তবে এটাকে একমাত্র সমাধান আমার মনে হয় না।”
প্রশাসনকে বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনকে দলীয় কাজে ব্যবহার এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়ার কারণেই অপরাধের বিচারের ‘গোড়ায় গলদ’ তৈরি হয় বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মর্তুজা হায়দার লিটন]