হজক্যাম্পের মেঝেতে পাশাপাশি ডজন ডজন ম্যাট্রেস পেতে এই শীতের মধ্যে যেভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে উপসর্গ অপ্রকাশিত অবস্থায় কারও শরীরে ভাইরাস থেকে থাকলে অন্যদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে নতুন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তাদের।
উহান থেকে দেশে ফিরতে ইচ্ছুকদের তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নানসাং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. রেজা সুলতানুজ্জামান। সেখানে থাকা বাংলাদেশিদের খবর জানাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তখন থেকেই সহযোগিতা করছিলেন তিনি।
আরও ৩১১ জন বাংলাদেশির সঙ্গে সুলতানুজ্জামানও শনিবার দুপুরের আগে আগে বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকা পৌছান। আটজনের জ্বর থাকায় তাদের পাঠানো হয় ঢাকার দুটি হাসপাতালে। সুলতানুজ্জামানসহ বাকিদের পাঠানো হয় আশকোনার হজ ক্যাম্পে।
এই বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চীনে থাকার সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, যেহেতু তারা এখনও আক্রান্ত নন, আর সেখানে যেহেতু আতঙ্কের মধ্যে অবরুদ্ধ দশায় দিন কাটাতে হচ্ছে, সেহেতু তারা দেশেই ফিরতে চান। সেজন্য দুই সপ্তাহ সবার থেকে আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণে থাকতেও তাদের আপত্তি নেই, কারণ তারা চান না তাদের মাধ্যমে ওই প্রাণঘাতী ভাইরাস দেশে ছড়াক।
উহানফেরত অনেকে বাসের জানালার ওপাশ থেকে সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন। অনেকে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। কিন্তু কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আশকোনায় পৌঁছে হজ ক্যাম্পের থাকার ব্যবস্থা দেখে তারা এখন নতুন করে ঝুঁকি অনুভব করছেন।
একটি অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ হলে সুলতানুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেখানে একটি রুমে ৭০ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে একসঙ্গে থাকতে হচ্ছে। পরিবেশও পরিচ্ছন্ন নয়। তাতে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কাই তার মনে জাগছে।
“বলা হয়েছিল আমাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আমরা খুশি মনেই তাতে রাজি ছিলাম। কিন্তু এটা তো কোয়ারেন্টাইনের পরিবেশ নয়। কোয়ারেন্টাইন মানে আপনাকে একদম আলাদা করে রাখবে। তাছাড়া এখনে মশার এত উৎপাত, তাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যদি নাও হই, ডেঙ্গু হলেই খবর হয়ে যাবে। বিশেষ করে শিশুরা তো এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে থাকে।”
রেজা সুলতানুজ্জামান জানান, সেখানে অনেক মানুষ মিলে একটি ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হচ্ছে। বালতিও একটি। অথচ এ রোগ থেকে বাঁচতে সব সময় পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি।
“মনে হচ্ছে আমরা আরও বিপদে পড়ে গেলাম এখানে এসে। আমাদের তারা বলছে, আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু এটাতো ডে বাই ডে ডেভেলপ করার জিনিস না। রোগটা সম্পর্কে আগে জেনে প্রস্তুতি নিয়ে তারপর কাজ করতে হবে। আসার পর ব্যবস্থা নিলে তো কাজ হবে না।”
মধ্য চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর নতুন এক করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। একে বলা হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাস বা ২০১৯-এনসিওভি।
২০০২ সালে সার্স এবং ২০১২ সালের মার্সের মত একই পরিবারের সদস্য নভেল করোনাভাইরাস সাধারণ ফ্লুর মত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে, ছড়াতে পারে মানুষ থেকে মানুষে।
করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এর লক্ষণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে, সঙ্গে থাকতে পারে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট। উপসর্গগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মত।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে এ রোগ কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে ডেকে আনতে পারে মৃত্যু।
নভেল করোনাভাইরাস এর কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এমন কোনো চিকিৎসা এখনও মানুষের জানা নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। আপাতত একমাত্র উপায় হল, যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বা এ ভাইরাস বহন করছেন- তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
“বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস থেকে সতর্ক থাকতে আমাদের এখানে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাউকে এখন পর্যন্ত মাস্ক সরবরাহ করে নাই। আর নারী, পুরুষ, শিশু- সবাইকে রাখা হয়েছে এক রুমে। উহানফেরত সবাইকে দিনে ২ লিটার করে পানি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অথচ প্রত্যেকের জন্য দেওয়া হয়েছে আধা লিটারের দুটো পানির বোতল। গরম পানিরও ব্যবস্থা এখনও হয়নি।”
দুপুরে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ নেওয়ার পর থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারও কোনো শারীরিক পরীক্ষা করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “চীনে বিমানে ওঠার আগে আমাদের বলা হয়েছিল প্রতিদিন নিয়মিত সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাবে। এখানে আসার পর আমি একজন ডক্টরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন কেউ অসুস্থ না হলে চেকআপ করবে না। জ্বর না থাকলে পরীক্ষাই যদি না করবে, তাহলে এখানে এভাবে রাখার কোনো মানে হয় না।”
টঙ্গীর বাসিন্দা মফিদুল ইসলামের ছেলেও আছেন আশকোনার ‘কোয়ারেন্টাইন’ ক্যাম্পে। এক রুমে অনেকের থাকার ব্যবস্থা হওয়ায় তিনিও আশঙ্কায় আছেন।
“আমার ছেলে হুবেইয়ে থাকত। এখানে আসার পর তাকে উহান থেকে আসা সাতজনের সঙ্গে একটি রুমে থাকতে দিয়েছে। আল্লাহ না করুক তারা কেউ যদি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তো আমার ছেলেও আক্রান্ত হতে পারে। এটা নিয়ে তো টেনশন হচ্ছে।”
তারপরও যে ছেলে দেশে ফিরে এসেছে, তাতেই খুশি উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান শরীফের বাবা শরীফুজ্জামান। চীন থেকে বিশেষ বিমানটি ঢাকায় পৌঁছানোর পর শরীফুজ্জামানও বিমানবন্দরে এসেছিলেন।
“ইউনিভার্সিটিতে তারা সেইফে ছিল। ইউনিভার্সিটিতে সব সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হত। খাবার দাবারও পরীক্ষা করে দিত। প্রতিবার খাবার দেওয়ার আগে শারীরিক পরীক্ষা করা হত। সেই হিসেবে সেখানে খারাপ ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি কোন দিকে যায় বলা যায় না। এ কারণে বলেছি চলে আস। পরিস্থিতি ভালো হলে আবার যাবে। এখন আর কোনো টেনশন নাই।”
উহান থেকে ফেরা এই মানুষগুলো এবং তাদের স্বজনদের উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চীন থেকে আসা যাত্রীদের পর্যবেক্ষণের এই পুরো প্রক্রিয়ায় মুশতাকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে সরকার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সাধারণত কোয়ারেন্টাইনে একসঙ্গে এত লোক থাকে না। তবে আমাদের এখানে ‘স্ট্রাকচারড কোয়ারেন্টাইন’ এখনও হয়নি বলে আপাতত তাদের এভাবে রাখা হচ্ছে। এখানেও কোনো সমস্যা তাদের হবে না।
“বাইরে থেকে কারও এখানে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। আর কারও মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলেই তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া হবে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোয়ারেন্টাইন’ যেন ‘সত্যিকার কোয়ারেন্টাইন’ হয় সেই চেষ্টা তারা করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিএমএইচের একটি যৌথ মেডিকেল টিম আশকোনায় ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে।
এখানে তাদের থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাইকে ১৪দিন থাকতে হবে বিষয়টি এমন না। আমরা তাদের অ্যাসেস করব, যদি দেখি কোনো আশঙ্কা নাই তাহলে হয়ত তারও আগেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।”