ডিএসসিসির নতুন ওয়ার্ড: বর্জ্য আর মশার সঙ্গে বসবাস

নির্বাচনী প্রচারের ডামাডোলের মধ্যেই ঢাকা দক্ষিণের হাজীনগর এলাকার একটি চা দোকানে গল্প করছিলেন কয়েকজন। এক বছর আগে সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডটির এই বাসিন্দাদের আলোচনায় যতটা না ভোট রয়েছে, তার চেয়ে বেশি রয়েছে বঞ্চনার কথা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2020, 03:30 AM
Updated : 16 Jan 2020, 03:36 AM

তারা সবাই এক বাক্যে বলেন, গত নয় মাসে কিছু রাস্তার উন্নয়ন করা হয়েছে। আর কয়েকটি সড়কে বসানো হয়েছে সড়কবাতি।

আর কোনো উন্নয়নের দেখা তারা পাননি।

স্কুলশিক্ষক মশিউর রহমান মুসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সাবেক সারুলিয়া ইউনিয়ন, মাতুয়াইল ও ডেমরা ইউনিয়নের কিছু অংশে পানি সরবরাহ নাই। আমরা সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে পানি উঠাই। অনেকের বাড়িতে টিউবওয়েল আছে। কিন্তু এটা তো স্থায়ী সমাধান না। এতে ধীরে ধীরে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।”

হাজিনগর এলাকাটি পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডে। এর মতোই ১৮টি ওয়ার্ড কাগজে কলমে সিটি করপোরেশনে যুক্ত হলেও এখনও নাগরিক সুবিধা আসেনি এগুলোর বাসিন্দাদের কাছে।

অনেক জায়গায় এখনও সড়ক নেই, থাকলেও তা অপ্রশস্ত; নেই সড়কবাতিও। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খাবার পানি সরবরাহ, মশা নিধন, জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। খেলার মাঠ, পার্ক, কমিউনিটি সেন্টারের মতো নাগরিক সুবিধার কথা এখনও ভাবতে পারেন না এ ওয়ার্ডগুলোর বাসিন্দারা।

সিটি করপোরেশনের নতুন এই ওয়ার্ডগুলোতে প্রথম নির্বাচন হয়েছে গত বছরের ১ মার্চ। বছর না গড়াতেই আবার ভোটের হাওয়া লেগেছে সেখানে।

সোমবার এই ওয়ার্ডগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে নির্বাচনের উত্তাপ। বিভিন্ন সড়কে উড়ছে প্রার্থীদের পোস্টার, চলছে নির্বাচনী প্রচার। এলাকার মোড়, দোকানপাটগুলোয় চলছে আগামী ৩০ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আলোচনা।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা কবে তারা পাবেন, তাই এখন জানতে চান তারা।

হাজীনগর এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম থেকে তারা এখনও বঞ্চিত। এলাকায় সিটি করপোরেশনের কোনো ডাস্টবিন বসেনি। ভ্যান দিয়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহ করা করা হয়। তবে এসব বর্জ্য সিটি করপোরেশনের মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে যায় না। ভ্যানওয়ালারা সেগুলো ঢাকা-ডেমরা সড়কের পাশে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়।

সরেজমিন দেখা যায়, মাতুয়াইল থেকে কোনাবাড়ি হয়ে পাইটি পর্যন্ত সড়কের বাম পাশে আবর্জনার স্তূপ।

প্রতিটি বাসা থেকে আবর্জনা নেওয়ার জন্য অন্তত ১০০ টাকা করে নেওয়া হয় বলে জানান ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডের পাড়াডগাইর এলাকার বাসিন্দা রমজান আলী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ডাস্টবিন নেই। ময়লা ফেলার কোনো জায়গা নেই। আমাদের এখান থেকে কিছু ময়লা ভ্যানে করে নিয়ে যায়। বাকিগুলো ফেলা হয় ডোবা-নালায়। এ কারণে এলাকাগুলো অপরিচ্ছন্ন।”

এলাকাগুলোতে এখনও প্রচুর ডোবা-নালা রয়েছে। পতিত পড়ে থাকা অনেক নিচু জমিতে বছর পানি, ময়লা আবর্জনা জমে থাকে। মশার উপদ্রবের কথাও বলেছেন স্থানীয়রা।

৬৬ নম্বর ওয়ার্ডের বড়ভাঙা এলাকার বাসিন্দা আমান উল্লাহ আমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা মশা। সন্ধ্যার পরে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ নেই। এত মশার অত্যাচার। ময়লা আবর্জনার কারণে মশা জন্মায়ও বেশি। আর মশা মারার কোনো কার্যক্রম তো দেখিনি কোনোদিন।”

নতুন ওয়ার্ডগুলোর বেশিরভাগ সড়ক অপ্রশস্ত। এসব এলাকায় পাড়ামহল্লার সড়কগুলো ৬ ফুট থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত। কয়েকটি ওয়ার্ডের কিছু এলাকায় সড়কই নেই। সবচেয়ে করুণ দক্ষিণগাঁও ও নাসিরাবাদ ইউনিয়নের ৭১ থেকে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার।

নতুন ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়ন করতে চাইলে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে বলে মনে করেন দক্ষিণগাঁও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শহীদুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যধিক খারাপ। অনেক এলাকায় রাস্তাই নেই। থাকলেও বেশিরভাগই সরু। এসব রাস্তা দিয়ে মূল সড়কে যাওয়া কঠিন। কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিতেও বেগ পেতে হয়।

“নতুন ওয়ার্ডের কোনো কাজই হয় নাই। এখন দুয়েকটা সড়কের কাজ হচ্ছে, সেগুলো সাবের হোসেন চৌধুরী সাহেবের নেওয়া প্রকল্পের আওতায়।”

অপরিকল্পিত গড়ে ওঠা নতুন ওয়ার্ডগুলোয় কোনো খেলার মাঠ নেই, নেই পার্কসহ চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা। একারণে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান বামৈল এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানকার বাসিন্দারা সবাই শুধু নিজের বাড়ি করার চিন্তা করেছে, মাঠ বা খোলা জায়গার কথা কেউই ভাবেনি।

“আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেকটা প্রতিবন্ধীর মতো বেড়ে উঠছে। একটা বাচ্চা যদি সারাদিন বাসায় বসে থাকে, মাঠ নাই, পার্ক নাই, কিচ্ছু নাই। সে কিভাবে স্বাভাবিক মানুষ হবে?”

মাতুয়াইল ও সারুলিয়া এলাকার ৬৩, ৬৪, ৬৬, ৬৭ এবং ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডগুলো ঢাকা-ডেমরা সড়কের দক্ষিণপাশে পড়েছে। ঢাকা ওয়াসার খাল সড়ক থেকে এসব এলাকাকে ভাগ করেছে। স্টাফ কোয়ার্টার থেকে মাতুয়াইল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় ১০টি কালভার্ট দিয়ে এসব এলাকার বাসিন্দারা ঢাকা-ডেমরা সড়ক উঠে রাজধানীসহ অন্যান্য এলাকায় যাতায়াত করেন।

তবে এসব কালভার্ট সরু বলে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে বলে জানান ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের টেংরা এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে যেখানে ২০ হাজার লোক বাস করত, এখন সেখানে বসবাস করে ৫০ হাজার লোক। এ কারণে প্রচুর যানবাহন চলাচল করে। কালভার্টগুলো প্রশস্ত করা জরুরি।”

২০১৬ সালের ৯ মে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় ঢাকার আশপাশের ১৬টি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সে বছর ২৮ জুন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন ১৬টি ইউনিয়ন যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

ইউনিয়নগুলো যুক্ত হওয়ায় ঢাকাৱ সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন ১২৯ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ২৭০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। নতুন এসব এলাকাকে নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সংখ্যা ৩৬টি বাড়ে।

ডিএসসিসিতে যুক্ত শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল, সারুলিয়া, ডেমরা, মান্ডা, দক্ষিণগাঁও ও নাসিরাবাদ ইউনিয়ন নিয়ে ৫৮ থেকে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড করা হয়েছে। ডিএনসিসিতে যুক্ত বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করা হয়েছে ৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড।

এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের আমুলিয়া এলাকার বাসিন্দা গোলজার হোসেনের চাওয়া, তাদের এলাকা যেন সিটি করপোরেশনের অন্য এলাকার মতোই হয়।

তার ভাষায়, তারা এখনও শুধু কাগজে-কলমেই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা।

“আমরা তো ঢাকা সিটি ভিতরে। কিন্তু হেইরম উন্নতি কিন্তুক আমাগো এলাকায় অয় নাইক্কা। অহনও আমরা কোনো সুযোগ সুবিধা পাই নাই। যারাই ক্ষমতায় আহে, আমরা চাই রাস্তাঘাট, ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার হবে, লাইটের পোলগুলায় লাইট বসবে।”