সারওয়ার আলীর সন্দেহ জঙ্গিদের, পুলিশ এখনও স্পষ্ট নয়

মুক্তিযোদ্ধা ডা. সারওয়ার আলীর সন্দেহ, তার বাড়িতে হামলাকারীদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে হামলাকারীদের উদ্দেশ্য কী ছিল, তা এখনও স্পষ্ট হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2020, 04:21 PM
Updated : 7 Jan 2020, 04:52 PM

রোববার রাতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলীর উত্তরার বাড়িতে ঢুকে পড়ে দুই দুর্বৃত্ত; তারা সারওয়ার আলীকে মেঝেতে শুইয়ে তার গলায় ছুরি ধরেছিল। কিন্তু প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে যায়।

ওই বাসায় দুর্বৃত্তদের ফেলে যাওয়া একটি মোবাইল সেট পায় পুলিশ। পরে নিচতলায় গ্যারেজে থাকা একটি ব্যাগ থেকে ৭টি স্টিলের চাপাতি, একটি সিম ছাড়া মোবাইল সেট, একটি প্রেশার মাপার যন্ত্র, একটি আইপ্যাড, লাইলেনের দড়ি পাওয়া যায়।

সারওয়ার আলী মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্বৃত্তদের রেখে যাওয়া চাপাতি দেখে মনে হচ্ছে, তারা জঙ্গি হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে এসেছিল। হত্যাচেষ্টাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।”

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও দাবি করেছে, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের কারণে সারওয়ার আলীকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা হয়েছে।

তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা না করাটা ‘ধোঁয়াশা’ মনে হচ্ছে সারওয়ার আলীর কাছেও।

তবে তিনি বলেন, “হয়ত তাদের ব্যাগে চাপাতিসহ যে আইপ্যাড পাওয়া গেছে, হত্যা করে সেই আইপ্যাড দিয়ে ভিডিও করে প্রচার করত তারা।”

কেন এটাকে নিছক ডাকাতি মনে করছেন না, তার ব্যাখ্যায় সারওয়ার আলী বলেন, “ডাকাত হলে তারা তো প্রথমেই মোবাইল নেবে, হাত-পা বেঁধে ফেলবে, চাবি চাইবে। এসবের কিছুই করেনি তারা।”

ছুরি ধরলেও আঘাত না করার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার ধারণা, তারা নিচ থেকে আরও কয়েকজনকে নিয়ে এক সাথে হত্যার ঘটনা ঘটাত এবং তা জঙ্গি মতাদর্শের মতো ভিডিও করে প্রচার চালাত।”  

যে দুজন হামলাকারী ঘরে ঢুকেছিলেন, তারা কেউ সারওয়ার আলীর পরিচিত নন। তাদের দুজনের কাছে ছয় ইঞ্চির মতো লম্বা দুটি ছুরি ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে পাওয়া ঘটনার বর্ণনা অনুযায়ী, ওই ভবনের তৃতীয় তলায় সারওয়ার আলীর মেয়ের ফ্ল্যাটে আগে হামলা চালানো হয়।

রাত সোয়া ১০টার দিকে দরজার কড়া নাড়লে তার মেয়ে সায়মা আলী (৪৯) দরজা খুলে দেন। দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজন অজ্ঞাত ব্যক্তি ধাক্কা দিয়ে ঢুকে উপুড় করে ফেলে সায়মার গলায় ছুরি ধরে। তার স্বামী হুমায়ুন কবীর (৫২) এবং তাদের মেয়ে (১২) এগিয়ে এলে তাদেরও ছুরি ধরে বসিয়ে রাখা হয়। এসময় ধস্তাধস্তিতে হুমায়ুন কবীর আহত হন।

পরে তাদের কাছে সারওয়ার আলী কোন তলায় থাকেন, তা জানতে চায় দুর্বৃত্তরা। এরপর হামলাকারী একজন চারতলায় গিয়ে কড়া নাড়লে সারওয়ার আলী দরজা খুলে দেন। তখন ওই ব্যক্তি সারওয়ার আলীকে মেঝেতে ফেলে গলায় ছুরি ধরে।

সারওয়ার আলী (ফাইল ছবি)

সারওয়ার আলীর স্ত্রী ডা. মাখদুমা নার্গিস চিৎকার করলে তৃতীয় তলায় থাকা অন্য দুর্বৃত্তও ছুটে আসেন। এসময় দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা সাহাবুদ্দিন চাকলাদার এবং তার ছেলে মোবাশ্বের চাকলাদার ছুটে আসেন। সাহাবুদ্দিন একজনকে জাপটে ধরেন এবং মোবাশ্বের একজন দুর্বৃত্তের দিকে কাচের গ্লাস ছুড়ে মারেন। তখন দুর্বৃত্তরা নিজেদের ছাড়িয়ে নিয়ে সাহাবুদ্দিন চাকলাদারকে আঘাত করে পালিয়ে যায় বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

ঘটনায় বাড়ির দারোয়ান মো. হাসান এবং হুমায়ুন কবীরের গাড়িচালক হাফিজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে মঙ্গলবার আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

সারওয়ার আলীর উপর হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন কুমার সাহা মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হামলা কী উদ্দেশ্যে হয়েছিল, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে সারওয়ার আলীর পূর্বের গাড়িচালক নাজমুলকে পাওয়া গেলে সব বিষয় পরিষ্কার হবে।”

পুলিশ জানতে পেরেছে, গ্যারেজে যে ব্যাগ পাওয়া যায়, তা রাত সাড়ে ৮টার দিকে নাজমুল এনে হাসানের কাছে দিয়েছিল।

সারওয়ার আলী বলেন, হামলাকারীদের একজন বাইরে কাউকে ফোন করে ‘মালামাল’ আনতে বলেছিল।

“মনে হচ্ছে, গ্যারেজে ব্যাগের ভেতর যে চাপাতিসহ অন্যান্য জিনিস পাওয়া গেছে, সেগুলো বাইরে অপেক্ষমান তাদের দলের কাউকে নিয়ে আসতে বলেছিল।”

নাজমুলের বিষয়ে সারওয়ার আলী বলেন, বছরখানেক আগে তাদের গাড়ি চালাতেন ওই চালক।

“চার মাস কাজ করার পর বনিবনা না হওয়ায় চলে গেছে। তার আচরণে জঙ্গি সাদৃশ্য ছিল বলে আমার স্ত্রী সে সময় জানিয়েছিল। তবে দারোয়ান হাসান বা গাড়িচালক হাফিজের জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো কিছু দেখিনি।”

ডিএমপির উত্তরা জোনের সহকারী কমিশনার শচীন মৌলিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যে মোবাইলটি পাওয়া গেছে সেটি নাজমুলের।

নাজমুলের সঙ্গে সারওয়ার আলীর জামাতার বর্তমান গাড়িচালক হাফিজুল এবং দারোয়ান হাসানের ফোনে যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এই হামলার ঘটনার সাথে জঙ্গিদের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।“

থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এই ঘটনার তদন্ত করছে। পিবিআইর একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করেছে।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সম্ভাব্য সব কিছু মাথায় রেখেই তারা কাজ করছেন।

ছায়ানটের সহসভাপতি সারওয়ার আলী ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রেনাটা লিমিটেডের চেয়ারম্যান।

সিপিবি-জাসদের উদ্বেগ

মুক্তিযোদ্ধা সারওয়ার আলীর উপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম।

এক বিবৃতিতে তারা বলেন, হত্যার উদ্দেশ্যে বাড়িতে ঢুকে ডা. সারওয়ার আলীর মতো বরেণ্য ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের উপর যেভাবে হামলা হয়েছে, তা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির বিষয়টি আবারও তুলে ধরেছে।

জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে সরকার ‘চরম ব্যর্থ’ দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, “পরিস্থিতি এখন এতটাই নাজুক যে, সন্ত্রাসীরা বাড়িতে ঢুকে হামলা চালানোর সাহস দেখাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।”

সারওয়ার আলীর উপর হামলা ‘কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার।

এক বিবৃতিতে তারা বলেন, মুক্তবুদ্ধি, যুক্তি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালিয়ানা চর্চার সাথে যুক্ত মুক্তমনা উদার মানুষদের উপর মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীরা যে চোরাগুপ্তা হামলা করেছে, ওই অপশক্তিই ডা. সারওয়ার আলীর উপর হামলা করেছে।

হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামও।