আদালতে হৈ চৈ-ভাংচুর কাম্য নয়: রাষ্ট্রপতি

প্রত্যাশিত রায় না পেয়ে আদালতে হৈ চৈ-ভাংচুর কাম্য নয় উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, মামলার রায় সম্পর্কে কোনো ধরনের পূর্ব ধারণা বা প্রত্যাশা থাকা উচিৎ নয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2019, 04:23 PM
Updated : 7 Dec 2019, 04:35 PM

শনিবার সন্ধ্যায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা বঙ্গভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে রাষ্ট্রপতি একথা বলেন।

আবদুল হামিদ বলেন, “বিচার বিভাগের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা এবং সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য বার ও বেঞ্চের ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। বার ও বেঞ্চ একে অপরের পরিপূরক। বিচার বিভাগের কাজ হচ্ছে মামলার বিষয়বস্তু ও বিভিন্ন ঘটনাবলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে মামলার রায় প্রদান করা। পক্ষান্তরে, বারের সদস্যদের কাজ হচ্ছে মামলা সম্পর্কিত ঘটনাবলী সঠিকভাবে উপস্থাপন করা, যাতে তার মক্কেল সঠিক বিচার পায়।

“মামলার রায় সম্পর্কে কোনো ধরনের পূর্ব ধারণা বা প্রত্যাশা থাকা উচিৎ নয়। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় যে, নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে সম্মানিত আইনজীবীগণ প্রত্যাশিত রায় না পেলে হৈ চৈ করে বিচার কাজে বিঘ্ন ঘটান। অনেক ক্ষেত্রে আদালত ভাংচুরসহ সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”

সর্বোচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে বিএনপির আইনজীবীদের হট্টগোলের দুই দিনের মাথায় একথা বললেন রাষ্ট্রপতি।

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন না আসায় বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় বিচারকের আপিল বেঞ্চ জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার জামিন প্রশ্নে শুনানি এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়।

ওই সময় জামিন আবেদনের শুনানি এগিয়ে আনার দাবিতে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা প্রায় তিন ঘণ্টা আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে অবস্থান নিয়ে তুমুল হট্টগোল করেন।

বিশৃঙ্খলার মধ্যে আর কোনো মামলার কার্যক্রম চালানো যায়নি। পুরোটা সময় আদালতকক্ষ থেকে বের হতে বা নতুন করে কাউকে ঢুকতে বাধা দেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। বার বার চেষ্টা করেও বিচারকাজ শুরু করতে না পেরে বেলা সোয়া ১টার দিকে এজলাস থেকে নেমে যান বিচারকরা।

বিশৃঙ্খলায় ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছিলেন, এটা ‘নজিরবিহীন’, ‘বাড়াবাড়ির’ একটা সীমা থাকা দরকার।

বিচারপতিদের সঙ্গে সাক্ষাতে বক্তব্যে আইন পেশার ঐতিহ্য বজায় রাখার আহ্বান জানান পেশায় আইনজীবী আবদুল হামিদ।

তিনি বলেন, “আইন পেশা একটি অত্যন্ত সম্মানজনক পেশা। এই পেশার ঐতিহ্য ও সম্মান বিজ্ঞ আইনজীবীদের সমুন্নত রাখতে হবে। বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদেরও এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে সচেতন থাকতে হবে। আমি আশা করি, বার ও বেঞ্চ সমন্বয়ে বিচার বিভাগ জনপ্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে।”

সরকারের তিন বিভাগের সম্পর্কের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ পৃথকভাবে দায়িত্বপালন করলেও তারা পরস্পর সস্পর্কযুক্ত। কেউ কারো প্রতিপক্ষ নন বরং পরস্পর সম্পূরক। তাই আপনাদেরকে পারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হবে। গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বিচার বিভাগ আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করে থাকে।

“১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর যাতে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার না হয় সেজন্য তৎকালীন স্বৈরশাসক কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পাশ করে। ফলে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়। দীর্ঘ দিন পরে হলেও সেই কালাকানুন বাতিল হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইনের শাসন।”

রাষ্ট্রপতি বলেন, “৭৫ পরবর্তী স্বৈরশাসকরা সংবিধানের ৫ম ও ৭ম সংশোধনী পাশের মাধ্যমে তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ৫ম ও ৭ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতির পিতার হত্যার বিচার, জেলহত্যা বিচার, ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার দ্রুত বিচারের ফলে জনমনে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বেড়েছে।”

ব্রিটেনে নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণে বিচার বিভাগের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, “বিচার বিভাগ সংবিধান ও আইনের রক্ষক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ স্বীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত প্রদানের এখতিয়ার  রাখেন। সংবিধান কিংবা আইনের কোন ধারা সম্পর্কে প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। তাছাড়া নাগরিকগণের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখতে কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কর্তৃপক্ষের নিকট ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। ব্রিটেনে বিচার বিভাগ নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

“আমরাও চাই, বিচার বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় রক্ষাকবচকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে কাজ করুক।”

রাষ্ট্রপতি এ সময় দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের বিচার প্রাপ্তি সহজ করতে একই ধরনের ওকালতনামা ফি নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

বঙ্গভবনের দরবার হলে ওই সাক্ষাত অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে রাষ্ট্রপতির দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন তারা।