পরিবহন শ্রমিকদের ‘স্বেচ্ছা কর্মবিরতিতে’ দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরের বেশ কিছু জেলায় গত দুদিন ধরেই বাস চলাচল বন্ধ ছিল। বুধবার সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও দূরপাল্লার বাস চলাচলে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যেই সকাল থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান ধর্মঘট। ফলে পণ্য পরিবহনে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে গাড়ি চলাচলে বাধা দিচ্ছে। রাজধানীর প্রধান বাস টার্মিনালগুলো থেকে কোনো বাস না ছাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
“গতকাল আমরা কর্মসূচি ঘোষণা করার পর রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একটা বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু সেখানে দাবি পূরণে কোনো আশ্বাস পাইনি। এজন্য কর্মবিরতি চলছে, এটা চলবে। আজ রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আবার বৈঠকের সম্ভাবনা আছে। বৈঠকে ইতিবাচক কিছু হলে তখন পরববর্তী সিদ্ধান্ত জানাব।”
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ট্রাক শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে বাস চলাচলে বাধা দিচ্ছে। বাস শ্রমিকরাও সড়ক আইনের বিরোধিতা করছেন, তারা কাজ করছেন না।”
আবার ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড, মদনপুর ও ডেমরায় বাস আটকে দেওয়া হচ্ছে।
শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের শুরু থেকে তার বিরোধিতা করে আসছিলেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।
সোমবার থেকে আইনটি কার্যকর শুরু পর কোনো চাপে পিছু হটবেন না বলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেওয়ার পর পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা দৃশ্যত চাপ বাড়িয়ে দেন।
আবুল কালাম বলেন, “সড়ক পবিরহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় শিথিল হতে বললেও তা হচ্ছে না। এ কারণে বাস চালক-শ্রমিকরাও আতঙ্কিত, তারা বাস চালাচ্ছে না।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর বাসগুলো আর ফেরত আসছে না।
“গত তিনদিন ধরে এই অবস্থা। এখান থেকে গিয়ে ওইপার থেকে আর গাড়ি ছাড়ে না। টুকটাক গাড়ি যাচ্ছে, যাত্রীরাও ভয়ে আসছে না। আবার গাড়ি ছেড়ে গেলে বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেডে পড়ছে।”
সড়ক আইন বাতিলের দাবিতে খুলনা ও বরিশাল বিভাগে যে শ্রমিক বিক্ষোভ চলছে, তার প্রভাব রাজধানীতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন গাবতলী বাস মালিক সমিতির সদস্য মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উদ্দেশ্যে যে গাড়িগুলো ছেড়ে যাচ্ছে, তা ওই জেলাগুলো থেকে তা আর ফিরে আসছে না। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা গাড়িগুলো ফিরতে দিচ্ছেন না। তাই ঢাকায় বাসের সংকট।"
বাস চলাচল প্রায় বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। মো. রুম্মান শেখ নামে চট্টগ্রামের এক যাত্রী জানান, রাজধানীর আরামবাগ ও সায়েদাবাদ কাউন্টার থেকে কোনো বাস ছেড়ে যাচ্ছে না।
গোপীবাগ থেকে কিশোরগঞ্জগামী এক বাসে উঠেও নেমে পড়তে হয়েছে বলে জানান জয়িতা বর্ষা নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী।
“বাস সায়েদাবাদে ঢুকতে না ঢুকতেই ঘুরিয়ে দেওয়া হল। বলছে কোথায় নাকি সড়কে আগুন দিয়েছে। পরে নেমে গেছি। এখন ট্রেনে যাওয়ার চেষ্টা করব।”
চট্টগ্রাম ও টেকনাফ রুটের সেন্টমার্টিন হুন্দাইয়ের কাউন্টার ম্যানেজার সোহেল বলেন, “সকাল থেকে একটাও বাস ছাড়তে পারিনি।যাত্রীরা কাউন্টারে এসে বসে আছে।”
গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, দূরপাল্লার বেশিরভাগ বাস চলাচল বন্ধ।
জর্ডান থেকে দেশে ফেরা আবদুল্লাহ আল মুকিত ঢাকা নেমে রাতে ছিলেন চাচার বাসায়। রংপুর যাওয়ার জন্য সকালে গাবতলীতে এসে তিনি বিপাকে পড়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কল্যাণপুর থেকে এসআর পরিবহনের টিকিট কিনেছিলাম। কিন্তু গাবতলী আসার পর টিকেট ফেরত নিয়েছে। বলছে গাড়ি যাবে না। খুব ঝামেলায় পড়ে গেলাম।"
সোহাগ পরিবহনের গাবতলী কাউন্টার থেকে দক্ষিণ বঙ্গের কোনো বাস ছাড়ছে না বলে জানিয়েছেন কাউন্টারের কর্মী শাহান।
মানিকগঞ্জ রুটের ভিলেজ লাইন পরিবহনের কাউন্টার সুপারভাইজার স্বপন আহমেদ জানালেন ‘ওইপার’ থেকে বাস ঢাকায় আসছে না। ফলে তাদের অর্ধেক বাস চলাচল বন্ধ।
দুপুরে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, গাড়ি না ছাড়লেও শত শত যাত্রী কাউন্টারের সামনে বা রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছেন। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে।
স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য কয়েক দিন আগে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসেছিলেন সুজন চৌধুরী। স্ত্রী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বুধবার বাড়ি ফেরার জন্য বাস ধরতে এসেছিলেন মহাখালী টার্মিনালে। কিন্তু গাড়ি না পেয়ে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি পড়েছেন বিপাকে ।
“ঢাকায় আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। হোটেলে থাকার মতো টাকাও আর বাকি নাই। এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না।”
সোমা চাকমা তার মেয়েকে নিয়ে ত্রিশাল যাওয়ার জন্য বাস ধরতে মহাখালীতে এসেছিলেন। বৃহস্পতিবার কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মেয়ের ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু গাড়ি না ছাড়ায় পড়েছেন দুঃশ্চিন্তায়।
ভোগান্তির শিকার আরেক যাত্রী বজলুর রহমান বলেন, “তিন দিন আগে নেত্রকোণা থেকে ঢাকায় এসেছিলাম আত্মীয়র বাড়িতে। আজকে চলে যাব, কিন্তু গাড়ি তো ছাড়ছে না। বাড়িতে আমার অনেক জরুরি কাজ।”
সড়ক আইনের বিরোধিতায় চট্টগ্রাম থেকেও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি চলছে ট্রাক-কভার্ড ভ্যান ধর্মঘট।
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস হলেও সেই পণ্য গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে না ট্রাক, কভার্ড ভ্যান, লরি ও প্রাইম মুভার বন্ধ থাকার কারণে।
খুলনায় বুধবার পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের বৈঠকে জেলার অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত ভেস্তে দিয়ে তৃতীয় দিনের মত চলছে চালক-শ্রমিকদের কর্মবিরতি।
উত্তর জনপদের সড়ক পরিবহনের অন্যতম কেন্দ্র বগুড়াতেও বাস-মিনিবাস চলছে না। ঢাকার কোনো কোচও সকাল থেকে টার্মিনাল ছেড়ে যায়নি। কাউন্টারে টিকেটও বিক্রি হচ্ছে না।
গাজীপুরে কয়েকটি বাসের ভাংচুর ও চালকদের মুখে পোড়া মবিল মেখে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিছু লোকাল বাস ছাড়া দূরপাল্লার বাস, ট্রাক ও লরি চলাচল বন্ধ রয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-ঢাঙ্গাইল মহাসড়কে।
টাঙ্গাইলের গোড়াই হাইওয়ে থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলছেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাড়ির সংখ্যা অন্য দিনের তুলনায় ৩০ শতাংশের বেশি হবে না।
কিশোরগঞ্জ থেকেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ সব জেলার বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী চলছে অনির্দিষ্টকালের ট্রাক ধর্মঘট।
একদল পরিবহন শ্রমিক সকালে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এসে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় অবস্থান নিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে রিকশা ও ভ্যানও চলাচলেও বাধা দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা অনেক গাড়ির চাবি কেড়ে নেয় বলেও অভিযোগ আসে।
দুপুরে পুলিশ সেখান থেকে শ্রমিকদের সরিয়ে দিলে আটকে থাকা যানবাহনগুলো সরে যাওয়ার সুযোগ পায়।
আরও খবর: