অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে দুর্ভোগ

নেতারা বলছেন ধর্মঘট ডাকেননি, তবুও বাস চলছে না খুলনা ও রাজশাহীর সড়কে। আকস্মিক বাস বন্ধে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে দূরগামী যাত্রীদের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2019, 06:45 PM
Updated : 18 Nov 2019, 06:48 PM

শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের একাংশে বাস মালিক-শ্রমিকদের এই প্রতিক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আসে, যে আইনের বিরোধিতা তারা শুরু থেকেই করে আসছিলেন।

সোমবার সকাল থেকে খুলনা অঞ্চল, রাজশাহী জেলায় বাস চলাচল থাকলেও পরিবহন মালিক কিংবা শ্রমিক নেতাদের কেউ ধর্মঘট ডাকার বিষয়টি স্বীকার করেননি।

মালিক নেতারা বলছেন, কঠোর আইন দেখে শ্রমিকরা বাস চালাতে চাইছে না। শ্রমিক নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ফিটনেসবিহীন বাস মালিকরাই নামাতে চাইছেন না। কেউ কেউ বলছেন, শ্রমিকদের কাজে পাঠানো যাচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে আগামী বৃহস্পতি ও শুক্রবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের বৈঠক ডাকা হলেও তার আগে জট খোলার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান সোমবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন আইনটি নিয়ে শ্রমিকরা ‘বিভ্রান্তিতে’ আছে।

“আমরা ২১ তারিখ এবং ২২ তারিখ শ্রমিক ফেডারেশনের বৈঠক করব। সেখানে এগুলো নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব। কোন কোন জায়গায় সংশোধন করা দরকার, সেটা করতে আমরা সরকারের কাছে দাবি তুলব। আমি বিশ্বাস করি, সরকার আমাদের দাবিগুলো বিবেচনা করবে।”

সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একবারও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে চালকদের দায়ী করেননি। সব দেশে আইন আছে, আমাদের দেশেও আইন থাকতে হবে। কিন্তু আইনটা যেহেতু সবার কাছে স্পষ্ট নয়, সেটা স্পষ্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে।”

তবে তার আহ্বানে ফল আসবে বলে মনে হচ্ছে না খুলনা অঞ্চলের শ্রমিক নেতাদের কথায়।

খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কাজী মো.নুরুল ইসলাম বেবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চালকরা নিজেদের ইচ্ছায় কর্মবিরতিতে গেছে। তাদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

“তারা আমাদের কথা শুনছে না। আমরা তাদের অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিলাম যে ২১-২২ তারিখ ফেডারেশনের মিটিং, সে পর্যন্ত আমাদের সময় দাও। কিন্তু তারা তাদের মতো কর্মবিরতিতে চলে গেল। চালকরা না আসলে গাড়ি চলবে কীভাবে?”

মঙ্গলবার যানবাহন চলাচল করবে কি না- জানতে চাইলে বেবী বলেন, “কারও কোনো হদিস নাই। কতদিন যে ধর্মঘট চলে আল্লাহ-মাবুদই জানেন।”

কর্মবিরতি না ডাকলেও চালকদের দাবির প্রতি একাত্মতা জানান বেবী।

তিনি বলেন, “একজন বাস চালকের মাসিক আয় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। তাদের যদি পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা হয়, ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় তাহলে তারা কীভাবে কাজ করবে?”

রাজশাহীতে অলস বসে বাস

সোমবার সকাল থেকে রাজশাহীর সঙ্গে বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা। ফলে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে শেরপুর জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার ঘোষ বলেন, বাস চালক-শ্রমিকরা নতুন পরিবহন আইনের ভয়ে স্বেচ্ছায় সব রুটে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধর্মঘট না হলেও আইনটি নিয়ে ভীতির কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি মো. মুসা।

তিনি সোমবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা (শ্রমিকরা) ভীত, শঙ্কিত এবং তাদের মধ্যে গাড়ি না চালানোর একটা চিন্তাভাবনা কাজ করছে। বিশেষ করে এই আইনের ৯৩ এবং ১০৫ ধারাটি নিয়ে আপত্তি বেশি।

“জামিন অযোগ্য এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করে দুর্ঘটনার জন্য  চালক দায়ী, সেক্ষেত্রে ৩০২ ধারায় মামলা করতে পারবে। ৩০২ ধারাই তো খুনের মামলা।”

গত বছর ঢাকায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস হয়।

বেপরোয়া মোটরযানের কবলে পড়ে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে এ আইনে, যা আগের তুলনায় বেশি।  

আইনটি এ বছরের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের আগে দুই সপ্তাহ সময় দেয় সরকার। সেই সময় পা হওয়ার পর সোমবার থেকে তা পুরোপুরি প্রয়োগের কথা বলেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটের মধ্যই তিনি বলেছেন, যত চাপই আসুক সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করা হবে। তবে আইন প্রয়োগে ‘অযথা বাড়াবাড়ি’ হবে না।

বাস বন্ধে দুর্ভোগ

সোমবার সকাল থেকে পরিবহন শ্রমিকদের অঘোতি ধর্মঘটের কারণে অনেকেই বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন বাস না পেয়ে, কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ছাত্রী আফসোনা আফরিন পাঁপড়ি কলেজে যাওয়ার জন্য সকালে বেনাপোল বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস পাননি। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি অসুস্থ, তারপরেও জরুরি কাজে কলেজে যেতে হবে। কিন্তু এখন বাসই বন্ধ, যেতে পারছি না।”

বেনাপোলে বাস না পেয়ে বিকল্পের সন্ধান

যশোর-বেনাপোল ও যশোর-সাতক্ষীরার অভ্যন্তরীণ রুটে কোনো যাত্রীবাহী বাস চলাচল না করলেও ঢাকা-কলকাতা ও বেনাপোল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য স্থানে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে বলে 'ঈগল পরিবহনের' বেনাপোল অফিসের ব্যবস্থাপক এম আর রহমান জানান।

মাগুরার কলেজছাত্র ইমন মিয়া ও চাকরিজীবী আকরাম হোসেন বলেন, তাদের প্রতিদিন যশোর-মাগুরা যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু মাগুরা থেকে যশোরের বাস ভাড়া ৬০ টাকা হলেও এখন এক থেকে দেড়শ টাকা দিয়ে ইজিবাইক, টেম্পু ও সিএনজিতে করে যাতায়াত করতে হচ্ছে।

ঝিনাইদহে ভাড়ায়চালিত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারচালকরাও কর্মবিরতি পালন করেন।

গাড়াগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে কামাল হোসেন নামে এক যাত্রী বলেন, জরুরি কাজে তার খুলনা যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাস বন্ধ থাকায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তিনি।

সকালে রাজশাহীর নগরীর শিরোইল ও নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল এবং ভদ্রা মোড়ে অবস্থান নিয়ে মোটর শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। এ সময় দু-একটি বাস ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তা আটকে দিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা।