প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে হাই কোর্ট মূল আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। আসামিরা যাতে বিদেশে পালাতে না পারে, সেজন্য পুলিশকে তৎপর হতেও বলা হয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, পুলিশ অচিরেই মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করে ফেলবে বলে তিনি আশাবাদী।
বরগুনা পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন রিফাতের বাবার করা মামলার আসামি বলে জানিয়েছেন সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন।
এদিকে নিহত রিফাত শরীফের দাফন হয়েছে বৃহস্পতিবার বিকালে সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামে পারিবারিক গোরস্থানে।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে রিফাতকে (২৩) স্ত্রীর সামনেই কুপিয়ে জখম করে একদল যুবক। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
রিফাতের ওপর হামলার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা। সেখানে দেখা যায়, দুই যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছে। আর তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বৃহস্পতিবার সকালে বরগুনা থানায় এসে একটি হত্যামামলা করেন। তাতে ১২ জনকে আসামি করা হয়।
আসামিদের মধ্যে চন্দন নামের একজনকে আগের রাতেই জেলা শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে সদর থানার ওসি আবীর হোসেন জানান।
বৃহস্পতিবার তিনি এজাহারভুক্ত আরেক আসামি হাসান এবং সন্দেহভাজন নাজমুল হাসানকে গ্রেপ্তারের খবর জানান।
ওসি বলেন, হাসান মামলার ৯ নম্বর আসামি এবং চন্দন ৪ নম্বর আসামি। নাজমুলের নাম এজাহারে নেই।
বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নি হামলাকারী সবাইকে চিনতে না পারার কথা জানালেও নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর নাম বলেছেন।
দুই মাস আগে রিফাতকে বিয়ে করা মিন্নি সাংবাদিকদের বলেন, বিয়ের আগে থেকেই তাকে উত্ত্যক্ত করত, হুমকি দিতেন নয়ন। বিভিন্ন সময় পথেঘাটে হেনস্তাও করেছে।
বুধবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মিন্নি বলেন, “আমি আর রিফাত কলেজ থেকে ফিরছিলাম। এ সময় কিছু ছেলে এসে রিফাতকে মারতে শুরু করে। আমি চেষ্টা করেও তাদের থামাতে পারি নাই।
“পরে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী আর রিশান ফরাজী এসে কোপানো শুরু করে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি; অস্ত্র ধরেছি; চিৎকার করছি; একটা লোকও আগায় আসেনি।”
রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের আত্মীয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
আর নয়ন এক সময় রিফাতের বন্ধু ছিলেন বলে বরগুনার ওসি আবির হোসেন জানান। তিনি আগের দিনই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মিন্নিকে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করে আসছিলেন নয়ন। এই বিরোধকে কেন্দ্র করেই রিফাতের উপর হামলা হয়।
নয়নের মা শাহিদা বেগম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, তার ছেলের সঙ্গে গত বছরের অক্টোবরে ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে মিন্নির বিয়ে হয়। কিন্তু সেই বিয়ে ৩ মাসের মধ্যেই ভেঙে যায়। পরে নয়নের বন্ধু রিফাতের সঙ্গে মিন্নির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বরগুনা পৌরসভার ক্রোক এলাকার নয়নের বিরুদ্ধে মাদক কারবার, হামলা, সন্ত্রাস সৃষ্টির নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি এর আগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলেও স্থানীয়রা জানায়।
নয়নসহ সব আসামিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন মিন্নিসহ রিফাতের স্বজনরা।
পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের প্রধান ডিআইজি মো. সফিকুল ইসলাম বলেছেন, “কোনো আসামিকে ছাড় দেওয়া হবে না। সব আসামি ধরা পরবে এবং বিচার হবে।”
চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “যেই কয়জন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল, তাদের সবাইকে আমরা ধরব। সবাইকে আইনের সামনে আমরা হাজির করে দেব।”
মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও পুলিশ ‘বসে নেই’ বলে দাবি করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে পুলিশের ভূমিকায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি হাই কোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান।
ঘটনা শুনে এজলাসে বসে তিনি বলেন, “যেহেতু গতকাল ঘটনাটি প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটেছে, তাই এর অ্যাকশন দ্রুত হওয়া উচিৎ ছিল। পুলিশের ভূমিকা জোরালো মনে হচ্ছে না।”
বিচারক এরপর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, বরগুনা যেহেতু সুন্দরবন ও সীমান্তের কাছে, সেহেতু আইজিপিকে জানাতে হবে যাতে আসামিরা কোনোভাবে সীমান্ত পার না হতে পারে।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত, তাদের যে কোনো মূল্যে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রধামন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।”
এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রিফাতের লাশের ময়নাতদন্ত শেষ হয়।
ময়নাতদন্ত শেষে সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জামিল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, রিফাতের দেহে আঘাতের বহু চিহ্ন ছিল। এর মধ্যে বুক, গলা আর মাথার আঘাত ছিল গুরুতর। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
এরপর বিকালে লাশ পৌঁছায় বরগুনায় তার বাড়িতে। সেখানে জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।