নুসরাতের ‘গলা চেপে ধরে’ মনি, ‘কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়’ জাবেদ

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তার দুই সহপাঠী কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন।

নাজমুল হক শামীম ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2019, 06:07 PM
Updated : 20 April 2019, 07:03 PM

শনিবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফ উদ্দিন আহম্মেদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তারা।

পরে মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, কামরুন নাহার মনি ও জাবেদ হোসেন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ঘটনার সময় বোরকা পরা পাঁচজনের মধ্যে এরা দুজন ছিলেন।

“নুসরাতকে হাত-পা বাঁধার পর মনি ছাদে শুইয়ে গলা চেপে ধরে। আসামি জাবেদ সে সময় নুসরাতের গায়ে এক লিটার কেরোসিন ঢেলে দেয় এবং ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।”

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানেন তিনি। আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতকে পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে এই ঘটনা ঘটানো হয়।

নুসরাতকে ছাদে ডেকে নেওয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তার আরেক সহপাঠী উম্মে সুলতানা পপি, যিনি অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি। পরদিন তার আরও দুই সহপাঠী এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলেন।

নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি শুক্রবার জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে কয়েকটি সংগঠন।

এই তিনজনকে নিয়ে নুসরাত হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিলেন সাতজন। অন্যরা হলেন- নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, আবদুর রহিম শরিফ ও হাফেজ আবদুল কাদের।

এই হত্যাকাণ্ডে দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়া ওই মাদ্রাসার ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীমের আত্মীয় কামরুন নাহার মনিই বোরকা কিনে ঘটনার দিন সকালে শামীমের হাতে দিয়েছিলেন।

নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার সময় ব্যবহৃত বোরকাগুলো যে দোকান থেকে কেনা হয়েছিল শুক্রবার দুপুরে মনিকে নিয়ে সোনাগাজী পৌরশহরের মানিক মিয়া প্লাজার সেই দোকানে অভিযান চালায় পিবিআই।

শনিবার সোনাগাজী সরকারি কলেজের পেছনের একটি খাল থেকে ওই তিনটি বোরকার একটি উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা। এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার তাদের আরেক সহপাঠী যোবায়েরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বোরকাটি পাওয়া যায় বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনীর পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানিয়েছেন।

জাবেদ হোসেন মাদ্রাসায় লেখাপড়ার পাশাপাশি সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলমের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। মাকসুদও এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন রিমান্ডে আছেন।

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকেও এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শনিবার বিকেলে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে ফেনীর একটি আদালত।

এদিকে নুসরাত হত্যায় জড়িত অভিযোগে শনিবার রাঙামাটি ও কুমিল্লা থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এরা হলেন- ইফতেখার উদ্দিন রানা (২১) ও মো. এমরান হোসেন মামুন (২২)। এরা দুজনও ওই মাদ্রাসায় নুসরাতের সঙ্গে পড়তেন।

দুজনেরই বাড়ি সোনাগাজীর চরগনেশ এলাকায়। ওই গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে রানা আর মামুনের বাবার নাম এনামুল হক।

ইফতেখার উদ্দিন রানা নামের এই যুবক নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের একজন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য

শনিবার ভোর রাতে রাঙামাটি সদরের টিঅ্যান্ডটি আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে রানাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈনউদ্দিন জানান।

আর কুমিল্লার পদুয়ারবাজার থেকে শনিবারই মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বিশেষ পুলিশ সুপার ইকবাল জানিয়েছেন।

পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় তাই ভাই যে মামলা করেছেন সেখানে ইফতেখার উদ্দিন রানা ও এমরান হোসেন মামুনের নাম নেই। তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য বেরিয়ে আসে।

তাদের ভাষ্য মতে, কারাগারে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে দেখা করে আসার পর তার অনুসারীরা মাদ্রাসার হোস্টেলে যে বৈঠকে বসে নুসরাতকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন, সেই বৈঠকে ছিলেন রানা ও মামুন।

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তারা হলেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্যাহ জনি, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, যোবায়ের হোসেন, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, মো. শামীম, কামরুন নাহার মনি, আবদুর রহিম শরিফ, হাফেজ আবদুল কাদের, ইফতেখার হোসেন রানা ও এমরান হোসেন মামুন।

মামলার এজহারভুক্ত আটজনের সবাই গ্রেপ্তারদের মধ্যে আছেন।