জিয়ার নির্দেশেই বইমেলায় অভিজিতকে হত্যা: অভিযোগপত্র

সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং ‘উগ্রপন্থি ব্লগার’ সাফিউর রহমান ফারাবীসহ ছয়জনকে আসামি করে বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2019, 04:38 PM
Updated : 11 April 2019, 01:25 PM

দীর্ঘ চার বছর তদন্তের পর আদালতে জমা দেওয়া এই অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে,  নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আগের নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) নেতা জিয়ার নির্দেশেই অভিজিতের ওপর হামলা হয়। জিয়ার নির্দেশ ছিল, একুশে বইমেলাতেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এ মামলার অভিযোগপত্র বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম।

আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এস আই নিজাম উদ্দিন মুনশি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঢাকার মহানগর হাকিম সরাফুজজামান আনছারি 'দেখিলাম 'বলে আভিযোগপত্রে সই করে আগামী ২৫ মার্চ শুনানির দিন ঠিক করে দিয়েছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ১২ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেলেও তাদের মধ্যে পাঁচজনের পূর্ণfঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। একজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে মোট ছয়জনকে। আসামিরা জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য।

চাকরিচ‌্যুত মেজর জিয়াউল হককে ধরিয়ে দিলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে

‘উগ্রপন্থি ব্লগার’ সাফিউর রহমান ফারাবী সিলেটের অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলারও আসামি

 

আসামিরা হলেন- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর বলে কথিত সৈয়দ জিয়াউল হক, যার সাংগঠনিক নাম সাগর ওরফে ইশতিয়াক ওরফে বড় ভাই, মো. মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, মো. আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে হাসিবুল ওরফে আব্দুল্লাহ এবং সাফিউর রহমান ফারাবী।

এই ছয় জনের মধ্যে জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির পলাতক। বাকি চারজন কারাগারে রয়েছেন।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে জঙ্গি কায়দায় হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়। চাপাতির আঘাতে আঙুল হারান তার স্ত্রী।

পদার্থবিদ অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি মুক্তমনা ব্লগ সাইট পরিচালনা করতেন তিনি। জঙ্গিদের হুমকির মুখেও তিনি বইমেলায় অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন।

ঘটনার পর শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন অধ্যাপক অজয় রায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাত ঘুরে মামলাটির তদন্তভার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে যায়।

অভিজিৎ ও বন্যা এবং তাদের অনুসরণকারী

তদন্তে যা জানা গেছে

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জানান, তদন্ত ও ঘটনাস্থলের আশপাশের ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিজিৎ হত্যায় সম্পৃক্ততা আছে এরকম মোট ১১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপারেশন, ইন্টেলিজেন্স ও ট্রেইনিং- এই তিন ভাগে তারা ওই হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।

এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মুকুল রানা ওরফে শরিফুল, যিনি ২০১৬ সালের ১৯ জুন ঢাকার খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

বাকি দশজনের মধ্যে পাঁচজনের সাংগঠনিক নাম জানা গেলেও আসল পরিচয় বা ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি। এরা হলেন সেলিম, হাসান, আলী ওরফে খলিল, আনিক ও অন্তু।

তাদের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেলে পরে সম্পূরর্ক অভিযোগপত্রের মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে মনিরুল সেদিন জানিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “ফারাবী ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিজিৎ রায়কে হত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলেন। এ কারণে প্ররোচনাদাতা হিসেবে তাকে এ মামলায় আসামি দেখানো হচ্ছে।”

গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে আবু সিদ্দিক সোহেল আদালতে ১৬৪ ধারায় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তার ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা থেকে বিস্তারিত বিবরণ অভিযোগপত্রে এসেছে।

সোহেল তার জবানবন্দিতে বলেন, ২০১৪ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেওয়ার পর মেজর জিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে জিয়া ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির তাকে প্রশিক্ষণ দেয়।

মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ও আবিররা তিনজন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের এক বাসায় থাকতেন। সায়মন ২০১৫ সালে ওই বাসায় ডেকে নিয়ে সোহেলকে জানান, অভিজিৎ রায়কে হত্যার নির্দেশনা পেয়েছেন তারা। ওই বাসায় ল্যাপটপে অভিজিতের ছবিও সোহেলকে দেখানো হয়।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে এই স্থানেই খুন হন অভিজিৎ রায়

সোহেলের জবানবন্দি অনুযায়ী, একুশে বইমেলায় যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসে ইন্দিরা রোডের যে বাসায় অভিজিৎ ও তার স্ত্রী উঠেছিলেন, তার চারপাশে রেকি করে মেজর জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন আকরাম। বইমেলাতেই অভিজিৎকে হত্যার নির্দেশনা দেন জিয়া।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সোহেল, সায়মন, আবির ও হাসান ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসি মোড়ে অবস্থান নেন এবং আনসারুল্লার অপারেশন শাখার নেতা মুকুল রানাকে খবর দেওয়া হয়।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে অভিজিৎ ও তার স্ত্রী বইমেলা থেকে বেরিয়ে টিএসসির উত্তর-পূর্ব পাশে গেলে আনসারুল্লার অপারেশন শাখার চারজন অভিজিৎকে কোপানো শুরু করে। বাধা দেওয়ায় বন্যাকেও আঘাত করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিজিৎকে প্রথম কোপ দেয় খলিল ও আনিক। পরে আরাফাত ও অন্তুও যোগ দেয়। একজন রিকশাচালক এগিয়ে এলে তাকে চাপাতি দিয়ে ভয় দেখান আনিক।

হতাকাণ্ড শেষে যাতে সবাই পালিয়ে যেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে জিয়া, সেলিম, আবির, হাসান ও সায়মনও সে সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের জন্য চাপাতি কেনার টাকা দেন মুকুল রান। টঙ্গী থেকে চারটি চাপাতি কিনে চারটি ব্যাগে ভরে আনা হয়।