নিলুফা ভিলার দুই নারী ‘জঙ্গির’ আত্মসমর্পণ

নরসিংদীর মাধবদীতে দুদিন ধরে ঘিরে রাখা নিলুফা ভিলায় অবস্থান নিয়ে থাকা সন্দেহভাজন দুই নারী জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2018, 09:05 AM
Updated : 17 Oct 2018, 03:38 PM

এর মধ্যে দিয়ে কোনো রক্তপাত ছাড়াই দীর্ঘ ৪১ ঘণ্টার স্নায়ুক্ষয়ী অপেক্ষার অবসান ঘটেছে বুধবার বিকালে। 

বেলা পৌনে ৩টার দিকে কালো বোরখা পরা ওই দুই নারীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পুলিশের একটি বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। সে সময় তাদের মাথায় হেলমেট দেখা যায়।

পরে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করে সাংবাদিকদের বলেন, নিলুফা ভিলার পঞ্চম তলার ওই ফ্ল্যাটে বেশ কিছু বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা নিয়ন্ত্রিভাবে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।

মনিরুল জানান, আত্মসমর্পণ করা দ্ইু নারীর নাম খাদিজা আক্তার মেঘনা এবং ইসরাত জাহান মৌ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ভগীরথপুরে আগের দিনের অভিযানে নিহত দুই ‘জঙ্গির’ পরিচয়ও পাওয়া গেছে।

“গতকাল নিহত জঙ্গিদের প্রাথমিক পরিচয় তাদের কাছে  জানতে পেরেছি। তাদের নাম আকলিমা রহমান মনি এবং আবদুল্লাহ আল বাঙালি। তারা স্বামী-স্ত্রী। আবদুল্লাহ নব্য জেএমবির মিডিয়া শাখার প্রধান। ”

মনিরুল বলেন, মেঘনা, মৌ, মনি মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের তিনজনসহ আরেক নারীকে ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার পর অগাস্টে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

“জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মিরপুর মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। তারা সাত-আট মাস জেলে থেকে বের হয়ে যায়। বের হওয়ার পর তারা কেউ নিজেদের বাসায় ফিরে যায়নি। হিজরতে গিয়েই জঙ্গি কাজে জড়িয়ে পড়ে।”

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল বলেন, “তারা নতুন ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছিল। আজকে যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের একজনের স্বামী নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা বলে আমরা জানতে পেরেছি। আরেকজনের এখনো বিয়ে হয়নি। তবে বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল, এটুকু জানতে পেরেছি।”

আকলিমা রহমান মনি

প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকার রেনেসাঁ প্রি-ক্যাডেট হাই স্কুল ও সাইনবোর্ড এলাকার হাজী আহাম্মদ আলী পাবলিক স্কুলে। উত্তরা হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং হলি চাইল্ড কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ২০১৩ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া এই তরুণী পড়ছিলেন ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষে।

ইসরাত জাহান মৌ

মিরপুর-২ এর ইসলামীয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি ও মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের বিসিআইসি কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন মৌ। মেডিকেল ও ইউনিভার্সিটি ভর্তির জন্য তিনি ইউসিসির ফার্মগেইট শাখায় কোচিং করেন। পরে ২০১৩ সালে ভর্তি হন মানারত ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি বিভাগে।

খাদিজা আক্তার মেঘনা

ঢাকার আহম্মদনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে এসএসসি ও ঢাকা ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন মেঘনা। ওই বছরই পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয়। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তিনি।

জঙ্গিদের অবস্থানের খবর পেয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও পুলিশ সদরদপ্তরের ল ফুল ইন্টারসেপশন সেলের (এলআইসি) সদস্যরা সোমবার রাত ৯টার দিকে মোটামুটি দুই কিলোমিটার ব্যবধানে মাধবদী পৌরসভার ছোট গদাইরচর এবং মেহেরপাড়া ইউনিয়নের ভগীরথপুরের দুটি ভবন ঘিরে ফেলে। 

এর মধ্যে ভগীরথপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে বিল্লাল হোসেন নামের এক কাপড় ব্যবসায়ীর পাঁচ তলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে মঙ্গলবার দুপুরে অভিযান চালায় সোয়াট। অভিযান শেষে সেখানে এক নারী ও এক পুরুষের লাশ এবং চারটি বিস্ফোরক ও অস্ত্র পাওয়ার কথা জানান মুনিরুল।  

এরপর বুধবার সকাল থেকে মাধবদীতে হাজী মো. আফজাল হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন সাত তলা ‘নিলুফা ভিলা’ ঘিরে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়।

বেলা পৌনে ১২টার দিকে কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশের প্রধান মনিরুল সাংবাদিকদের বলেন, চূড়ান্ত অভিযানের আগে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার সব ধরনের চেষ্টা তারা করবেন। যদি তাদের রাজি করানো না যায়, কেবল তখনই সোয়াট অভিযান শুরু করবে।

তাদের সেই চেষ্টায় সফল হওয়ার পর বিকালে খাদিজা আক্তার মেঘনা এবং ইসরাত জাহান মৌকে বের করে এনে নরসিংদী পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

ব্রিফিংয়ে মনিরুল বলেন, নরসিংদীর এ দুটি বাড়ি কেন জঙ্গিরা ভাড়া নিয়েছিল, তারা এখনও জানতে পারেননি। তবে মাধবদীর ওই বাড়িতে ‘আরও অনেকের’ যাতায়াত ছিল। দুটো বাসার মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

“দুটি বাসাই খুব কাছাকাছি সময়ে এই মাসের তিন তারিখে এবং পাঁচ তারিখে ভাড়া নেওয়া হয়। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য কী ছিল তা আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করে বের করার চেষ্টা করব।

“তবে আমরা এতটুকু বুঝতে পারছি, দুর্গা পূজার সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। এলাকাবাসীকে বলতে চাই, আমরা তাদের (জঙ্গি) নিস্ক্রিয় করতে পেরেছি। সে কারণে আতঙ্কের কোনো কারণ নাই।”

এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, নিলুফা ভিলার কাঠামো দুর্বল হওয়ায় সেখানে অভিযান চালানো বিপজ্জনক হতো। সে কারণে তারা ‘জঙ্গিদের’ আত্মসমর্পণে রাজি করানোর চেষ্টায় জোর দিচ্ছিলেন। 

“আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করছিলাম নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। আমরা আজ সকালেও বলেছিলাম যে নেগোসিয়েশনে জোর দিচ্ছি। যদিও তারা চেষ্টা করেছে ব্লাস্ট করার, আজকেও তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে একটা ব্লাস্ট করেছিল। কিন্তু আমাদের বোম ডিসপোজাল ইউনিট এবং অন্যান্য যারা আছে তারা নেগোশিয়েট করে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে।”

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এবং নরসিংদীর পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুনও এই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।

নরসিংদীর পুলিশ জানায়, ‘জঙ্গিরা’ ভগীরথপুর ও মাধবদীর ওই দুই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল নাজমুল ও হাফেজ নামে দুইজনের সহায়তায়। তাদের দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

সোমবার রাতে পুলিশ নিলুফা ভিলা ঘিরে ফেলার পর সোমবার সকালে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ৫০০ গজের মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এনে রাখা হয় বাড়ির কাছাকাছি।

বুধবার সোয়াটের অভিযান শুরুর সম্ভাবনার কারণে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকার লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলা হয়। মাধবদী বাজারের সব দোকান পাট, স্কুল,কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হয়।

তবে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করলে বিকালে স্থানীয় বাসিন্দাদের উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে।